ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সমালোচকরা। এইরূপ একটি আপত্তি হল –ভারতীয় দর্শন কি দুঃখবাদী দর্শন ? সমালোচকরা ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তির দিকে লক্ষ্য রেখে এই আপত্তি তুলেছেন, কিন্তু তার ভারতীয় দর্শনের অন্তিমকে লক্ষ্য করেননি। তারা যদি আন্তিমকে লক্ষ্য করতেন তাহলে এই রূপ আপত্তি তুলতে পারতেন না।
ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী না আশাবাদী / Indian philosophy is neither pessimistic nor optimistic
দুঃখবাদের অভিযোগ
ভারতীয় দর্শন জীজ্ঞাসা করার মূল উৎস হল জীবন সম্পর্কে অতৃপ্তি বোধ বা দুঃখবোধ। মানুষের জীবন কামনা-বাসনা ও আবেগের দ্বারা চালিত হয়, যার পরিণামে মানুষকে দুঃখ ভোগ করতে হয়। দুঃখবাদ অনসারে জীবনে কনো সুখ নেই, জীবন হল দুঃখে পরিপূর্ণ এবং জীবনে দুঃখের কোন সীমা নেই। প্রতি মুহূর্তে মানুষ রোগ-ব্যাধি, মৃত্যু প্রভৃতি কারণে দুঃখে অক্রান্ত হচ্ছে।জগত ও জীবনে দুঃখ-কষ্ট দেখেই ভারতীয় মুনি-ঋষিরা জীবন থেকে দুঃখ মুক্তির চিন্তায় গভীর সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন।
ভারতীয় প্রতিটি দর্শন সম্প্রদায় জীবনের দুঃখকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং দুঃখ থেকে মুক্তির পথ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন দর্শন সৃষ্টি করেছেন। ভারতীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দুঃখবাদের মূল কথা গুলি হল –
- বৌদ্ধ দর্শনে সবকিছুকেই দুঃখময় বলা হয়েছে।
- সাংখ্য দর্শনে আধিবৈদিক , আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক নামে ত্রিবিধ দুঃখের কথা বলা হয়েছে ।
- যােগ দর্শনে পরিণাম , তাপ এবং সংস্কার এই তিন প্রকার দুঃখের উল্লেখ রয়েছে।
- ন্যায় বৈশেষিক এবং মীমাংসা দর্শনেও বলা হয়েছে তত্ব জ্ঞান না হলে মানুষ দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারে না।
- বেদান্ত দর্শনের বলা হয়েছে ব্রহ্ম ছাড়া সবকিছুই দুঃখময়।
- গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগৎকে দুঃখের আলয় বলে বর্ণনা করেছেন।
তাই সমালোচকেরা ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভুলেছেন যে, ভারতীয় দর্শন সৃষ্টি হয়েছে দুঃখবাদ থেকে । জীবনের অন্ধকারময় রূপ দুঃখকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী দর্শন পরিণত হয়েছে ।
অভিযোগ খন্ডন
ভারতীয় দর্শনের বিরূদ্ধে সমালোচকদের এই অভিযোগ যুক্তি যুক্ত নয়।ভারতীয় দর্শনে দুঃখকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ কথা সত্য , কিন্তু কোন ভারতীয় দর্শানে এ কথা বলা হয় নি যে দুঃখেই জীবনের পরিসমাপ্তি। প্রত্যেক ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দুঃখবাদ আলোচিত হলেও আশাবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে। বার বার দেখানো যে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখবাদের স্পষ্ট রূপ দেখা যায় এবং দুঃখ থেকে মুক্তির মুক্তির পথও দেখানো হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনে বলা হয়েছে- ‘সর্বং দুঃখম’ অর্থাৎ সকল কিছুই দুঃখময়। সকল সুখের মাঝেই দুঃখ প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে। বৌদ্ধ পরিভাষায় জগতের সকল কিছুই অনিত্য। তাই দুঃখ অনিত্য। অষ্টাঙ্গিমার্গের যথাযথ অনুশিলনের দ্বারা মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
শুধু বৌদ্ধদর্শনে নয় উপনিষদ ও গীতাতেও দুঃখবাদ দেখতে পাওয়া যায়। উপনিষদে বলা হয়েছে ব্রহ্ম ছাড়া সব কিছুই দুঃখময়। তাই ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান হলেই দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। একইভাবে শ্রীমদ্ভদগীতাতে বলা হয়েছে- ব্রহ্ম জ্ঞান অগ্নির দ্বারা দগ্ধ হলে কোনো কমই ফল প্রসব করতে পারে না। আর তখনই জীবন থেকে দুঃখের আত্যন্তিক মুক্তি হয়।
ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মিমাংসা ও বেদান্ত এই ষোঢ় দর্শনের প্রত্যেকটির মধ্যে দুঃখবাদের আলোচনা রয়েছে।
ন্যায় দর্শনে বলা হয়েছে অপবর্গ বা মুক্তি লাভ করলে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়। সংখ্য দর্শনে দুঃখের তিনটি প্রকারের কথা বলা হয়েছে। যথা-আধ্যাত্মিক আধিবৌদ্ধিক ও আধিভৌতিক । বিবেক জ্ঞান বা বিবেক খ্যাতি অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদ জ্ঞান হলে দুঃখের আতন্তিক নিবৃত্তি হয়।
যোগ দর্শনে মহর্ষি পতঞ্জলি মানুষের পাঁচ প্রকার ক্লেশের কথা বলেছেন। বিবেগ জ্ঞান হলে আত্মা যখন স্বরূপে অবস্থান করে তখন সব ক্লেশের মুক্তি ঘটে এবং সেই অবস্থা হল মুক্তির অবস্থা। অদ্বৈত বেদান্তবিদ শঙ্করাচার্য বলেছেন অবিদ্যাঃ বশত জীর তার এম স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না। তাই বিভিন্ন দুঃখ মানুষকে আকান্ত করে। তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা জীব যখন ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করে তখনই দুঃখের মুক্তি হয়।
মূল্যায়ন
এই আলোচনা থেকে বলা যায় যে, দুঃখেই জীবনের শুরু , দুঃখেই জীবনের শেষ – এই নৈরাস্যময় জীবন চিত্র কোন ভারতীয় দর্শনে পাওয়া যায় না। বরং এ কথাই বলা হয়েছে সে জীবন দুঃখ দিয়ে শুর হলেও, জীবনের পরিসমাপ্তি যেন চরম সুখ দিয়ে হয়। সকল ভারতীয় দর্শনে তাই দুঃখময় জীবন থেকে মুক্তি লাভের পথ নির্দেশ করা হয়েছে।বলা যায় ভারতীয় দর্শন দুঃখ দিয়ে শুরু হলেও পরিনামে আশাবাদী বাণী শুনিয়েছে। তাই উপনিষদে ধ্বনিত হয়েছে-
“অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়”- অসত্যহতে আমাকে সত্যে নিয়ে চল, অন্ধকার হতে আমাকে আলোকে নিয়ে চল, মৃত্যু হতে আমাকে অমৃতে নিয়ে চল।
তাই বলা যায় ভারতীয় দর্শন শুরুতে দুখবাদী হলেও , আন্তিমে আশাবাদী।
Thanks for Reading- ভারতীয় দর্শন কি দুঃখবাদী দর্শন।
Read More: