ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা

প্রিয় পাঠক আজকের বাংলা রচনা পর্বে যে রচনাটি আমরা উপস্থাপন করতে চলেছি তা হল-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা । মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যামিক শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপনা , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা প্রবন্ধ রচনা । এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর রচনা তোমরা পেয়ে যাবে এই পেজে ,  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা class 6/7

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা

 

ভূমিকা : 

অনগ্রসর দেশে মাঝে মাঝে দু-একজন দেবতুল্য মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা দেশমাতৃকা ও সমাজের কুসংস্কার দূর করে, মানুষকে উৎসাহিত করেন শিক্ষাদীক্ষায় এবং দীনের বন্ধুরূপে মানবসেবার দৃষ্টান্ত রেখে যান। এমনি এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দরিদ্র ঘরের সন্তান হয়েও প্রতিভাবলে ও কর্মনৈপুণ্যে তিনি হতে পেরেছিলেন অসাধারণ। ‘বিদ্যাসাগর’ নামেই তিনি ভারত-বিখ্যাত, তবু বাঙালির কাছে তিনি ‘করুণার সিন্ধু’, ‘দয়ার সাগর’।

 ” বিদ্যাসাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে

করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে , দীন যে দীনের বন্ধু ! – উজ্জ্বল এই জগতে

হিমাদ্রির হেম -ক্লান্তি আম্লান কিরণে । “মাইকেল মধুসূদন দত্ত 

 

জন্ম বংশ :

তিনি মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন , এবং মাতার নাম ভগবতী দেবী ছিলেন সুগৃহিণী। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়দিকেই ছিল বিদ্যাবত্তার ঐতিহ্য। ঈশ্বরের পিতামহ রামজয় ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত । তিনিই স্বপ্নে দেখেছিলেন, তাঁর বংশে এক সুপুত্রের জন্ম হবে। নবজাতকটি হবে এঁড়ে বাছুরের মত একগুঁয়ে। পিতামহের ভবিষ্যদ্বাণী সফল করে ঈশ্বরচন্দ্র যথার্থই হয়েছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, প্রথিতযশা ও দয়ার অবতার।

শিক্ষাজীবন :

ঈশ্বরের বিদ্যাভ্যাসের শুরু গ্রাম্য পাঠশালায়। মেধায় ও স্মৃতিশক্তিতে তিনি ছিলেন অসাধারণ। আট বছর বয়সে পাঠশালা ত্যাগ করে পিতার সঙ্গে পায়ে হেঁটে তিনি কলকাতায় আসেন। আসার পথে মাইলস্টোন দেখে তিনি ইংরেজি রাশিমালা শিখে ফেলেন। পরে তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন । ছাত্রাবস্থায় তাঁকে পরের বাড়িতে থাকতে হত। রান্না করে, বাসন মেজে, তারপর সারারাত রাস্তার ধারের গ্যাসের আলোয় ঈশ্বর পড়া তৈরি করতেন। বরাবর তিনি কলেজে প্রথম হয়ে বৃত্তি পেয়েছেন।

কর্মজীবন :

কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান-পণ্ডিতরূপে বিদ্যাসাগর কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুকাল পরে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক এবং অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অতঃপর বিদ্যাসাগর বিদ্যালয় সমূহের পরিদর্শক পদটিও গ্রহণ করেন। মতান্তরের ফলে উচ্চ বেতনের এই চাকরিতে তিনি ইস্তফা দেন। বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে শিক্ষাবিস্তার ও সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘মেট্রোপলিটন কলেজ’ বর্তমানে ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’ নামে পরিচিত। বীরসিংহ গ্রামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভগবতী বিদ্যালয়’।

বাংলা গদ্যের জনক : 

তৎকালীন সমাজে শিক্ষালাভের পথে অন্তরায় ছিল পাঠ্যপুস্তকের অভাব। সেই তাগিদে তিনি লিখলেন ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বোধোদয়’, ‘আখ্যানমঞ্জুরী’, ‘উপক্রমণিকা’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। বাংলা গদ্যের তখন শৈশব দশা। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত রীতির অন্বয় ত্যাগ করে বাংলার নিজস্ব রীতিতে গদ্য লিখলেন ছেদচিহ্ন, যদি ইত্যাদির প্রয়োগে গদ্যকে অর্থবহ করলেন। গদ্যভাষার মধ্যেও দেখা দিল অন্তশ্ছন্দ। এইজন্যই বিদ্যাসাগরকে রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলা গদ্যের প্রথমশিল্পী’ বলেছেন।

সাবলীল ও ছন্দবিশিষ্ট্য, মধুর, প্রাঞ্জল ও প্রসাদগুণ সম্পন্ন গদ্য তিনিই রচনা করেন ।  শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’ তাঁর অনুবাদ-কর্ম হলেও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘বিদ্যাসাগর চরিত’তাঁর মৌলিক রচনার উৎকৃষ্ট নিদর্শন ।

সমাজ সংস্কারক : 

সমাজ-সংস্কারক হিসাবে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ প্রথার প্রচলন করে, অচল সমাজকে নতুনভাবে চলার বেগ দিয়েছেন।বাল্যবিধবাদের দুঃখ, দুর্গতি মোচনের জন্য তিনি কোঠর সংগ্রাম করেন । তাঁর আন্দোলনের প্রতি কিছু উদার দরদী মানুষের সমর্থন থাকলেও দুঃখের বিষয় তাঁর যোগ্য সহযোগী ছিল না । নিপীড়িতা ,অসহায়া বিধবাদের জন্য তাঁর নিরলস সংগ্রামের দৃষ্টান্ত বিরল । বাংলার নারীজাতির উন্নতি ও শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন । বাংলার নারীশিক্ষার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর । বর্ণ বৈষ্ণম্য , ও জাত পাত , ভেদাভেদের উর্দ্ধে ছিলেন তিনি । কুসংস্কারের অন্ধকারে নিম্মজিত জাতির উন্নতিই ছিল তাঁর জীবনের পণ ।

“এখনো পূর্ণিমার রাত্রে আলো হয় ।

আলোর স্বভাবে স্খলিত তরঙ্গধ্বনি বুন ঝোপে কিংবা  চূর্ণ পাথরের দেশে ছিন্ন ভিন্ন জনপদে ,

বস্তিতে আসল অন্ধকারে ধনুষ্টংকারের বীজ বেড়ে ওঠে ।”মণিভূষণ ভট্টাচার্য্য 

উপাধি : 

বীর সিংহের সিংহ শিশু । বিদ্যাসাগর , তাঁর স্বভাবের কাঠিন্য , সংগ্রামী মনের দুর্ধর্ষ বেগবত্তা , উগ্র পুরুষবিক্রম, প্রমাণ করেন তিনি  যথার্থ  সিংহ শিশু । মাত্র বারো বছর বয়সে সংস্কৃত সাহিত্য ,ব্যাকরণ, ন্যায়,বেদান্ত, স্মৃতি, অলংকার প্রভৃতি নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ,মেধাবী ঈশ্বর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় ‘বিদ্যাসাগর’ ।

চরিত্র : 

বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র বিদ্যার সাগর ছিলেন না , ছিলেন দয়ার সাগর । বিদ্যাসাগরের চরিত্র সদগুণের আধার। তিনি ছিলেন বজ্রের মত কঠোর, আবার প্রয়োজনে কুসুম-কোমল। অন্যায় সহ্য করেননি, আবার পরের দুঃখে চোখের জলও ফেলেছেন। অনাথ-আতুরের সেবা করেছেন। দুঃখী মানুষের জাত বিচার করেননি। তাঁর অকুণ্ঠ দানে এবং নিরলস সেবায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রাণ ফিরে পেয়েছে অনেক মানুষ।কোন প্রার্থী কাছে হাত পেতে বিমুখ হননি কখনো , তাঁর খ্যতি বংলার ঘরে ঘরে বিদিত । বিদ্যাসাগরের একটি বিশিষ্ট্য গুন ছিল মাতৃভক্তি । তাঁর মাতৃভক্তি আমাদের দেশে প্রবাদ বাক্যের মত। মায়ের ডাকে বর্ষার ভয়ঙ্কর দামোদর নদকেও তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক দেশপ্রেমিক এবং খাঁটি বাঙালি।

উপসংহার : 

আজীবন পরোপকারী, দরিদ্র-বান্ধব ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা ও বাঙালির গর্বস্থল। এমন দৃঢ়চেতা পুরুষ সর্বদেশে সর্বকালে দুর্লভ।

” তিনি ছিলেন আর্য ঋষির মত জ্ঞানী,

ইংরেজ সৈনিকের মত তেজস্বী এবং বাঙালি মায়ের মত স্নেহপ্রবণ।” কবি মধুসূদন দত্ত ।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই বিদ্যসাগরের এই মহান মনিষী পরলোক গমন করেন । বাঙালির নমিত মেরুদণ্ডকে সোজা করতে বিদ্যাসাগরই একমাত্র মানুষ, যাঁকে বারংবার স্মরণ করতে হবে। বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতিকে এক লড়াকু ঐতিহ্যবাহী , সংস্কৃতির বাহক হিসাবে পরিচিত করেছেন তেজোদৃপ্ত বিদ্যাসাগর । তাই দেশের  তরুণ-তরুণীদের , কিশোর কিশোরীদের ঈশ্বরচন্দ্রকে নতুন করে চিনতে হবে , ঈশ্বরচন্দ্র মানে মাতৃভক্তি নয়, ঈশ্বরচন্দ্র মানে বিধবাবিবাহ নয়, ঈশ্বরচন্দ্র মানে দয়া দাক্ষিণ্য নয় , ঈশ্বরচন্দ্র মানে হল ইস্পাত যে ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয় জাতীয় জীবনের কাঠামো । তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর চরিত্র-মাহাত্ম্য স্মরণ করে লিখেছেন – তিনি নবীন ছিলেন এবং চিরযৌবনের অভিষেক লাভ করিয়া বলশালী হয়েছেন । তাঁর এই নবীনতা আমার কাছে সবচেয়ে পূজনীয় , কারণ তিনি আমাদের দেশে চলার পথ প্রস্তুত করে দিয়ে গেছেন ।

Thanks For Reading : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা 

 

■ অনুরূপ প্রবন্ধঃ

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী

 বীরসিংহের সিংহ শিশু

 সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর

 একজন মহাপুরুষের জীবনী রচনা

 


আরো পড়ুনঃ   


 

Leave a comment