আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো

আধুনিক পাশ্চত্য দর্শনের জনক ফরাসী দার্শনিক রেনে ডেকার্ত । ডেকার্তের দর্শন থেকে  আমরা একটি গুরুত্ব প্রশ্ন উত্তর নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি সেটি হল –আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো। এই প্রশ্নটির উত্তর ba philosophy notes আকারে লেখা হয়েছে।

আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো
আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো

 

আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো | I think , therefore, I am

ফরাসী দার্শনিক রেনে ডেকার্ত দর্শনকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যথার্থ জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্য তিনি প্রচলিত বিশ্বাস ও মতবাদে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তুর অস্তিত্বেও। এমনকি তিনি গণিত ও নীতি শাস্ত্রের মৌলিক নিয়ম গুলিতেও সংশয় প্রকাশ করেন।

কিন্তু এমনভাবে সংশয় করতে করতে সংশয় এমন জায়গায় এসে পৌঁছায়, সেখানে আর সংশয় করা চলেনা। আমি যে কোন বস্তুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সংশয় পোষন করতে পারি, কিন্তু একটি বস্তু যার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কখনোই সংশয় প্রকাশ করার উপায় নেই, সেটি হল, চৈতন্য বিশিষ্ট চিন্তন ক্রিয়া সম্পাদক যে ‘আমি’ আর অস্তিত্ব।

সংশয় একটি চিন্তন ক্রিয়া। সংশয় করতে গেলেই চিন্তা করতে হয়। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, কোন সর্বশক্তিমান পুরুষ আমার সাথে প্রতারনা করছেন ও আমার মনে ভ্রান্তি, সংশয় প্রভৃতি উৎপন্ন করছেন তা হলেও একথা সত্য যে, আমি যদি না থাকতাম তাহলে তার পক্ষেও এরকম করা সম্ভব হতো না।

সুতরাং “আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি”- এটি এমন একটি সত্য যা সকল সংশয়ের উর্দ্ধে। ডেকার্তের মতে প্রকৃত জ্ঞান লাভের পথে আমরা এই সত্যের উপলব্ধি থেকে যাত্রা আরম্ভ করতে পারি।

ডেকার্তের সমসাময়িক দার্শনিক গ্যাসেন্ডি “আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি” – ডেকার্তের এই উক্তির বিরুদ্ধে এক অভিযোগ উত্থাপিত করেন। তিনি বলেন, এটি একটি ন্যায় অনুমান, যার পূর্নরূপটি হলঃ

   সকল চিন্তাশীল বস্তু হয় অস্তিত্বশীল।

আমি হই চিন্তাশীল।

ஃ আমি হই অস্তিত্বশীল।

          উক্ত এই ন্যায়টি চক্রক দোষে দুষ্ট। ডেকার্তের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, অ্যারিস্টটলীয় ন্যায় অনুমান “Dictum de Omniet nullo” এই নীতি দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ন্যায় অনুমানের প্রধান আশ্রয় বাক্যের অস্তিত্বসূচক পূর্ব স্বীকৃতি থাকে।

সুতরাং এই ধরনের পূর্বস্বীকৃত নেই যে বচনে তা কখনোও ন্যায় অনুমানের প্রধান আশ্রয় বাক্য হতে পারেনা। এখানে ডেকার্তের আসল বক্তব্য হল, “সকল চিন্তাশীল বস্তু হয় অস্তিত্বশীল” -এই বচনটির অস্তিত্ব সূচক পূর্বস্বীকৃতি নেই। আসলে এটিকে একটি প্রাকল্পিক বাক্য বলাও যাবে না  যেহেতু “আমি চিন্তা করি অতএব আমি”- এটি কোন ন্যায় অনুমান নয়।

আধুনিক কিছু কিছু যুক্তি বিজ্ঞানীর মতে, ডেকার্তের “Cogito Ergo sum” হল ন্যায় ভিন্ন আকারের অনুমান। এর আকারটি হল –

                   I think Presuppoes I exist

                   I think (P)

                ஃ I exist (q)

          এই অনুমানটি যে নীতি দ্বারা পরিচালিত তা হল (P⊃q), (~ P⊃q)। এই নীতিটি স্পষ্টই Dictum থেকে ভিন্ন। সুতরাং বিবেচনাধীন অনুমানটি ন্যায় ভিন্ন আকারের। এই ন্যায় অনুমানের দ্বিতীয় আশ্রয়বাক্য বস্তুত সত্য। শুধু তাই নয়, এটি সংশয়াতীত। এই অর্থে যে একে অস্বীকার করলে স্ববিরোধ দোষ ঘটে।

এর দ্বিতীয় আশ্রয়বাক্যটি উদ্দেশ্য বিধেয় আকারের। উদ্দেশ্য বিধেয় আকারের বাক্যে উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব পূর্ব থেকে স্বীকার করে নিয়েই বিধেয়, উদ্দেশ্য সম্পর্কেই কিছু বলা হয়। সুতরাং “I exist” সিদ্ধান্ত করলে তা শুধু যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় না , তার বস্তুগত সত্যতাও স্বীকৃত হয়। এই কারণে এই অনুমানটি সম্পর্কে বলা হয় যে, “It is not only valid but also a good inference ” -অনুমান

এই অনুমানের সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে স্বীকৃত হওয়ার অভিযোগ উঠতে পারে যে, এটি চক্রক দোষে দুষ্ট। গ্যাসেন্ডি বলে যে , I walk Presuppoes I exist ; I walk, therefore I exist – এভাবেও আমার অস্তিত্ব প্রমাণিত হতে পারে। উত্তরে বলা হয় যে, এই অনুমানের দ্বিতীয় আশ্রয়বাক্যটি হল দূর্বল, এই অর্থে যে এটিকে অস্বীকার করলে কোন স্ববিরোধ দোষ উৎপন্ন হয় না। ফলে এটি সংশয়াতীত নয়। তুলনামূলক ভাবে এটি অধিকতর ভাল এবং মৌলিক।

ডেকার্ত নিজে “আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি”- এই মৌলিক সত্যটিকে কোন অনুমান লব্ধ সত্য বলেননি। তাঁর মতে এটি সাক্ষাৎ অনুভবের বিষয়। চিন্তন ক্রিয়া ও অস্তিত্ব অবিচ্ছেদ্য । এই সাধারণ সত্যে উপনীত হওয়ার পূর্বে আমাকে উপলব্ধি করতে হবে যে, চিন্তনকর্তা হিসাবে ‘আমি’ অস্তিত্বশীল।

ডেকার্তের মতে, চিন্তন মনের সারধর্ম, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মন সব সময়ের জন্য চিন্তা করবে। মনের সব সময় চিন্তা করার ক্ষমতা আছে এইরূপ ধারণা করলেই যথেষ্ট। তাহলে দেখা যাচ্ছে ডেকার্তের মতে চিন্তনের জন্য কোন চিন্তন কর্তার প্রয়োজন।

সমালচনাঃ

১.  অনেকে অভিযোগ করে বলেন যে চিন্তনের জন্য চিন্তন কর্তার প্রয়োজন এই উক্তিকে ডেকার্ত কোথাও প্রমাণ করেননি। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, চিন্তনের জন্য কোন চিন্তন কর্তার প্রয়োজন, তাহলেও তার থেকে ডেকার্ত কথিত কোন স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। আধুনিক চিন্তাবিদ্‌ রাসেল ডেকার্তের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ এনেছেন। হিউমের দর্শনেও এই প্রকার অভিযোগ লক্ষ্য করা যায়।

২. ডেকার্তের বিরুদ্ধে আর একটি আপত্তি হল এই যে, আমাদের চিন্তা সাক্ষাৎ ভাবে কেবলমাত্র চৈতন্য বিশিষ্ট আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করে, কিন্তু সেটি ভিন্ন অন্য কোন বস্তু নির্দেশ  করে না ডেকার্তের এই মত ভ্রান্ত। আমি চিন্তা করছি এটা যদি সন্দেহাতীত হয় তাহলে আমার চিন্তার একটা বিষয় আছে একথাও অবশ্যই স্বীকার করতে হয়।

৩. হেগেলপন্থী দার্শনিকেরা ডেকার্তের মতের সমালোচনা করে বলেছেন যে, ডেকার্ত ‘অহং’ – এর প্রকৃতিকে অনুভব করতে ভুল করেছেন। অহং কেবল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ জীবমাত্র নয়, এ হল অনন্ত চৈতন্য যা ব্রক্ষের সাথে অভিন্ন। হেগেল ডেকার্তের প্রশংসাও করেছেন। তিনি বলেন “আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি ” এই উক্তিতে দর্শন তার প্রকৃত ভিত্তি পূর্ব প্রাপ্ত করেছে। কেননা স্বতঃ নিশ্চিত চিন্তা থেকে নয়, কোন আপ্ত বাক্য থেকেও নয়। হেগেলের কথার অর্থ হল এই যে, চিন্তনই সত্যের প্রতিষ্ঠা ভূমি কোন বস্তু জগৎ নয়।

Thanks For Reading: আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো


প্রশ্ন উত্তর

১.আমি চিন্তা করি সুতরাং আমি আছি উক্তিটি কার।

উত্তর- আমি চিন্তা করি সুতরাং আমি আছি উক্তিটি হল ফরাসী দার্শনিক রেনে ডেকার্তের।

২. রেনে দেকার্তের বিখ্যাত উক্তি কি?

উত্তর- রেনে দেকার্তের বিখ্যাত উক্তিটি হল -আমি চিন্তা করি সুতরাং আমি আছি । 

৩. রেনে দেকার্ত কে আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয় কেন?

উত্তর-  রেনে দেকার্তের মধ্যযুগের দর্শনের সমালোচনা করে এক নতুন দর্শন আবিষ্কার করেন এবং তাঁর দর্শনকে আনুসরণ করে আনেক আধুনিক দার্শনিক তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। তাই রেনে দেকার্ত কে আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয়।


আরো পড়ুন –

দেকার্তের মতে ধারণা কয় প্রকার ও কী কী

অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব

জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো

চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?

ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ


 

Leave a comment