আগের অংশে আমরা আলোচনা করেছি চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা ও আধীবিদ্যা, এই অংশে আমরা আলোচনা করবো চার্বাক নীতি তত্ত্ব। ভারতের অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায়দের থেকে চার্বাক নীতি তত্ত্ব কি ভাবে সুখবাদে পরিণত হয়েছে তা এই আলোচনায় তুলে ধরা হল।
চার্বাক নীতিবিদ্যা-সুখবাদ
চার্বাক নীতিবিদ্যা জড়বাদ বা সুখবাদ নামে পরিচিত। চার্বাক মতে দেহ অতিরিক্ত আত্মা নেই, দেহই আত্মা । ধর্ম, অর্থ , মোক্ষ ও কাম এই চারটি পুরুষার্থের মধ্যে চার্বাকগন কামকেই পরমপুরুষার্থ বলেছেন ।
ধর্ম, অর্থ , মোক্ষ ও কাম এই চারটি চতুবর্গ পুরুষার্থ নামে পরিচিত ।এই চারটি পুরুষার্থের মধ্যে চার্বাকরা কামকেই পরমপুরুষার্থ বলেছেন । তবে কাম বা সুখ লাভের সহায়ক হিসেবে অর্থকেও গৌণ রূপে গণ্য করা হয়েছে । ‘অঙ্গনলিঙ্গনজন্য সুখমেব পুমর্থ।’– অর্থাৎ অঙ্গন আলিঙ্গনের দ্বারা যে দেহ সুখ উৎপন্ন হয় , তাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য । তাই চার্বাক দার্শনিকদের hedonist বলা হয়।
চার্বাক মতে , মৃত্যুর মাধ্যমে দেহের পরিসমাপ্তি ঘটে । তাই চার্বাকগন বলেন , ‘যাবৎ জিবেৎ সুখং জিবেৎ ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ-’অর্থাৎ যতদিন বাঁচ সুখে বাঁচ এবং ঋণ করেও ঘি খাও।‘পিব, খাদ চ’- অর্থাৎ খাও দাও , দেহ সুখ ভোগ কর । এটাই জীবনের পরম পুরুষার্থ ।
মোক্ষবাদীরা বলেন দেহসুখ সম্ভব হলেও তা ক্ষনিক । কিন্তু চার্বাকগন বলেন ক্ষনিক হলেও তা একেবারে শুন্য নয় ।‘Rather a Peigon today than a peacock tomorrow ’ “A pure shell is better than a doubtful golden coin.” ‘দেহসুখ সম্ভোগ’,বা ‘ইন্দ্রিয়সুখ সম্ভোগ’ কিন্তু ‘আত্মসুখ ন সম্ভোগ।’
দেহাত্মবাদী চার্বাকদের নৈতিক আলোচনা ভোগবাদে পরিণত হয়েছে । ভোগবাদী চার্বাকেরা বলেন দেহ অতিরিক্ত স্বতন্ত্ররূপে আত্মা বলে কিছু নেই। তাই আত্মার সম্পর্কিত যুক্তি প্রলাপমাত্র। ইহলোক সর্বস্ব চার্বাকদের মতে মোক্ষ মস্তকহীন মানুষের শিরপীরার মতো উপহাস্যের বস্তু । চার্বাক মতে জড়বস্তুর সংমিশ্রনে তৈরি দেহ সুখ দুঃখ মিশ্রিত। দেহ থকলে সুখ থাকবে এবং দেহ গেলে সুখ দুঃখের অবসান ঘটবে । তাই মানুষের নৈতিক কর্তব্য হল দুঃখকে সর্বান্তকরনে কমিয়ে দৈহিক সুখ ভোগ করা।
চার্বাক দর্শনের ঞ্জানবিদ্যা ও অধীবিদ্যা পড়ুন প্রশ্ন-উত্তর
দেহ সুখ-দুঃখ মিশ্রিত । তাই বলে দৈহিক সুখ উপেক্ষা করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয় “ Give up eating fish because there are bones.”-মূর্খ ব্যক্তিরাই মাছে কাঁটা আছে বলে মাছ খাওয়া ত্যাগ করে, কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা অতি সহজে কাঁটা বেছে সার অংশটুকু ভক্ষন করেন। অর্থাৎ দেহ থাকলেই সুখ-দুঃখ থাকবে । তাই চার্বাক মতে মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সর্বত্রভাবে দুঃখ কমিয়ে সুখ ভোগ করা।
মোক্ষবাদীরা বলেন , সুখভোগ ক্ষনিকের জন্য। চার্বাকেরা মোক্ষবাদীদের এই মন্তব্য স্বীকার করে বলেন ক্ষনিক হলেও একেবারে মূল্যহীন নয়, মিথ্যা নয়। সূর্যোদয়,সূর্যাস্ত, রংধনু ক্ষনিক হলেও এদের অস্তিত্ব অস্বীকারযোগ্য নয় অর্থাৎ দৈহিক সুখ সম্ভব, কিন্তু আত্মসুখ সম্ভব নয় ,কারন দেহ অতিরিক্ত আত্মা বলে কিছু নেই।
ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষগোচর নয়, তাই ভবিষ্যৎ সুখলাভের আশায় বর্তমান সুখ থেকে বিরত থাকা উচিৎ নয়। এইভাবে চার্বাক নীতিবিদ্যা দৈহিক সুখবাদে পরিণত হয়েছে।
সমালোচনা-
চার্বাক নীতি তত্ত্ব pdf
চার্বাকদের এইপ্রকার অসংযত দেহগত সুখকেই মানবজীবনে পরম পুরুষার্থ বলা যায় না। দেহজ সুখ কামনা ইতর প্রানীদের থাকে।মানুষের পরম পুরুষার্থ যদি দেহজ সুখ হয় তাহলে ইতর প্রাণীদের সাথে মানুষের কোন পার্থক্য থাকে না।
মানুষ কেবল দৈহিক সুখে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না , মানুষ হল অসীমের পিয়াসী। জীবনের একটি সময়ের পর কামিনী কাঞ্চনের সুখ কমে যায়। তখন মানুষ তার কর্ম ও জ্ঞানকে ভালবাসে। তাই দেহসুখ মানুষের পরম পুরুষার্থ হতে পারে না । তাই পরবর্তীকালে সুশিক্ষিত চার্বাকগন উপনিষদের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আরো পড়ুন –
১. ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ
অসংখ্য ধন্যবাদ চার্বাক নীতিবিদ্যা অংশটি পড়ার জন্য।
প্রশ্ন-উত্তরঃ
১. চার্বাক নীতি তত্ত্ব কি নামে পরিচিত? আথবা চার্বাক নীতি তত্ত্বের নাম কি?
উত্তর- চার্বাক নীতি তত্ত্ব সুখবাদ নামে পরিচিত। কারন চার্বাক মতে দেহ অতিরিক্ত আত্মা বলে কিছু নেই। দেহের বিনাশে সকল কিছু শেষ হয়ে যায়। তাই যতদিন দেহ আছে সুখ ভোগ করে যায়।
২. চার্বাক মতে পুরুষার্থ কয়টি ও কি কি?
উত্তর- ভারতীয় দর্শনে পুরুষার্থ চারটি যথা ধর্ম , অর্থ ,কাম ও মোক্ষ। কিন্তু চার্বাকগন চারটি পুরুষার্থের মধ্যে কামকে প্রধান পুরুষার্থ এবং অর্থকে সহায়ক পুরুষার্থ বলেছেন।