প্রিয় পাঠক আজকের বাংলা রচনা পর্বে যে রচনাটি আমরা উপস্থাপন করতে চলেছি তা হল-আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রবন্ধ রচনা । মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যামিক শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপনা , জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞানী রচনা । এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর রচনা তোমরা পেয়ে যাবে এই পেজে , জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞানী রচনা class 10/12।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রচনা
ভূমিকা :
উনিশ শতকে নবজাগরণের দিনে এদেশের যে মানুষটি আপন প্রতিভাবলে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। ভারতের একজন সফল বাঙালি বিজ্ঞানী। পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যায় যিনি একাধিপত্য লাভ করেছিলেন । বিজ্ঞান ও গবেষণার এক বদ্ধ দ্বারের উন্মোচন করেন তিনিই । ‘উদ্ভিদের ও প্রাণ আছে’ এই আবিষ্কারের ফলে বিশ্বের দরবারে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার অন্তর্গত রাঢ়িখাল গ্রামে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর জগদীশচন্দ্রের জন্ম হয়। পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে, ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মাতার নাম বামা সুন্দরী দেবী ।
বাল্য ও শিক্ষাজীবন :
ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চ পদস্থ চাকুরিরতা সত্ত্বেও বালক জগদীশচন্দ্রকে তিনি গ্রামের বাংলা পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। বাল্যকালে প্রশ্ন করা ছিল জগদীশচন্দ্রের স্বভাব। গাছ, লতাপাতা সম্বন্ধে তাঁর ছিল সীমাহীন কৌতূহল। ছাত্রজীবনে গ্রামে থাকার সময়ে নানাপ্রকার গাছপালা ও কীটপতঙ্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি যথাক্রমে প্রবেশিকা ও বি.এ. পাশ করেন। এরপর তিনি ডাক্তারি পড়তে বিলেত যান। শারীরিক কারণে তাঁকে ডাক্তারি পড়া ছাড়তে হয়। কেমব্রিজে ভর্তি হয়ে তিনি পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা পড়তে আরম্ভ করেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ‘ট্রাইপস্’ নিয়ে পাশ করেন। লন্ডনের বি-এস্-সি ডিগ্রি নেবার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন :
স্বদেশে ফিরে জগদীশচন্দ্র কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। পদমর্যাদা সত্ত্বেও ইংরেজ অধ্যাপকের তুলনায় ভারতীয় অধ্যাপকদের তখন কম বেতন দেওয়া হত। এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ স্বরূপ জগদীশচন্দ্র বেতন বর্জন করেন। তিন বছর বিনা বেতনে অধ্যাপনা ও গবেষণা করার পর তাঁকে স্থায়ী অধ্যাপকের যোগ্য বেতন ও পদমর্যাদা দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারটি তখন ছিল ছোট, যন্ত্রপাতির অভাবও তিনি প্রতি পদে অনুভব করতেন।
সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের ব্যয়ে তিনি দেশি মিস্ত্রি দিয়ে যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলেন। নিজ উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে কলেজ থেকে এক মাইল দূরবর্তী নিজের বাড়িতে বিনা তারে শব্দ প্রেরণ করে তিনি সকলকে বিস্মিত করেন। ক্রমে তাঁর গবেষণা গুণিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-এস্- সি উপাধি দেয়।
আবিষ্কার :
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্রই প্রথম বিনা তারে শব্দ প্রেরণ-কৌশল আবিষ্কার করেন। কিন্তু আইনত যন্ত্রটির প্রচার হয়নি, তাই ইতালীয় বিজ্ঞানী মার্কনি এ ব্যাপারে অগ্রণী বলে গৃহীত হন।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের বিশ্ব-বিজ্ঞান মহাসভায় তিনি দেশের মুখোজ্জ্বল করেন। জগদীশচন্দ্রের গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, প্রাণী দেহের মত উদ্ভিদ দেহেও চেতনা আছে, তাদেরও ব্যথা-বেদনা অনুভূতি আছে। কৃত্রিম উপায়ে এবং কোন উদ্দীপকের সাহায্যে তাদের দেহে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা যায়। তাঁর উদ্ভাবিত ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ যন্ত্র হাতে নাতে সবকিছু প্রমাণ করে দিতে পারে। তাঁর এই আবিষ্কার জীব জগতে এক নতুন পথের দিশা দেখায় , মনুষ্যজগতের সঙ্গে উদ্ভিদ জগতের পরিচিতি ঘটে ।
তপের প্রভাবে বাঙালি সাধক জড়ের পেয়েছে সাড়া
আমাদের এই নবীন সাধনা শব-সাধানার বাড়া । – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ।
বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা :
দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী-সমাজে জগদীশচন্দ্রের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। কোন সরকারি সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজের অর্থে ভারতীয় রীতিতে নির্মিত কলকাতার ‘বসু-বিজ্ঞান-মন্দির’ জগদীশচন্দ্রের একটি মহান কীর্তি। মাতৃভূমিতে মৌলিক-বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতিকল্পে এই ‘মন্দিরটি তিনি উৎসর্গ করে গেছেন। সিভি রমণ , মেঘনাথ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো গুণী জনেরা বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । বর্তমানে ভারতের প্রাচীনতম অন্যতম প্রধান গবেষণাগার বসু বিজ্ঞান মন্দির । তৎকালীন কুসংস্কারাছন্ন ,পরাধীন ভারতেও তিনি জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলেছিলেন। তাই কবির ভাষায়-
‘অপেক্ষা করেনি সে তো জনতার সমর্থন তরে
দুর্দিনে জ্বেলেছে দীপ রিক্ত তব অর্ঘ্যথালি -পরে ।
আজি সহস্রের সাথে ঘোষিল সে ,”ধন্য ধন্য তুমি ”
ধন্য তব বন্ধুজন ,ধন্য তব পুণ্য জন্মভুমি ।‘-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
প্রতিভাবান সাহিত্যিক :
জগদীশচন্দ্র ছিলেন একজন গুণী সাহিত্যিক। বিজ্ঞানী হলেও তাঁর লেখার মধ্যে কবিত্বের স্ফুরণ ছিল যথেষ্ট প্রশংসার যোগ্য। ভাবে ভাষায় খাঁটি সাহিত্যের মেজাজ তিনি তৈরি করতে পারতেন। জগদীশচন্দ্রের ‘অব্যক্ত’ একখানি অতুলনীয় গ্রন্থ। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে এক সুত্রে বাঁধেন। জগদীশচন্দ্রকে কল্পবিজ্ঞানেরও জনক বলা হয় , তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য রচনা ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ প্রথম ‘কুন্তলীন পুরষ্কার’ লাভ করেন ।
উপসংহার :
বাংলাদেশ তাঁর কাছে ছিল প্রাণাধিক প্রিয়। বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন স্বদেশ প্রেমিক , কোনদিন তিনি ভারতের বাইরে যাবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ভারতের বিজ্ঞান-কুঞ্জে একদিন শত শত কোকিলের কুহুতান শোনা যাবে, একথা তিনি বিশ্বাস করতেন। জগদীশচন্দ্রের সে বিশ্বাস আজ সত্যে পরিণত হয়েছে , বসু বিজ্ঞান মন্দির গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে । কিন্তু ,কালের নিয়মে অবশেষে ৭৯ বছর বয়সে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু পরলোক গমন করেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রিয়তম সখার উদ্দেশ্যে বলে গিয়েছেন-
” বিজ্ঞান লক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিম মন্দিরে দূর সিন্ধুতীরে,
হে বন্ধু গিয়েছ তুমি ; জয়মাল্যখানি , সেথা হতে আনি
দীন হীনা জননীর লজ্জানত শিরে, পরায়েছ ধীরে ।”
Thanks For Reading : আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রবন্ধ রচনা ।
■ অনুরূপ প্রবন্ধঃ
একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রচনা
বিজ্ঞান-লক্ষ্মীর প্রিয় বাঙালি
জগদীশ চন্দ্র বসু জীবনী
আরো পড়ুনঃ