কার্ল মার্কস সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছেন। সমাজতান্ত্রিক সমাজ হল বৈষম্য মুক্ত এক বিশুদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা । আমরা আজকের পোষ্টে আলোচনা করতে চলেছি কার্ল মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কি এবং প্রথমে আলোচনা করব সমাজতন্ত্র কি?
সমাজতন্ত্র কি । বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কি
সমাজতন্ত্র কি
সমাজতন্ত্র হল জাতীয় অর্থনীতি এবং সামগ্রিক পরিকল্পনার ওপর সামাজিক ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এই মতবাদে দেশের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিকানার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমাজতন্ত্র হল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ ধনতন্ত্রে অমানবচিত উৎপাদন পদ্ধতি শ্রমজীবি মানুষকে যন্ত্রে পরিনত করেছে ।
যান্ত্রিক ক্রিয়ায় আবদ্ধ হয়ে মানুষ তার স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে অনুভব করতে পারেনা। অর্থাৎ মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু সমাজতন্ত্র মানুষকে সমাজের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে স্বাধীন সত্তা হিসেবে আত্ম সচেতন করে রাখে। তাছাড়া সমাজতন্ত্রিক শাসনে সমাজে স্বাধীনতা, সাম্য, ও মৈত্রি প্রতিষ্ঠা হয় বলে মানুষ দেশপ্রেম ও সামাজিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং নিজে নিজে দায়িত্ব নিয়ে সমাজের উন্নতি করে। অর্থাৎ মানুষ অনুভব করে সমাজের স্বার্থে যে কাজ তা নিজ স্বার্থেরই কাজ।
C.E.M Joad তাঁর ‘Introduction to Modern Political Theory’ গ্রন্থে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন “Socialism, In short is like a hat that lost it’s shape because everybody wears it.” ‘অর্থাৎ সংক্ষেপে সমাজতন্ত্র হল একটি টুপির মতো যা প্রত্যেকে পড়ার দরুন আকৃতি বদলে গেছে।’ বস্তুত সমাজতন্ত্রবাদের মূল কথা হল উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় ব্যক্তি মালিকানার সম্পূর্ন বিলোপ সাধন করে সমাজ ও রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস মুখ্যত আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তা।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও বিচার-
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হল বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামগ্রিক সবিচার ও নিপীড়ন থেকে দরিদ্র ও শোষিত মানুষের মুক্তি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শ সম্বন্ধিত মতবাদ। সমাজ যা বাস্তব পরিস্থিতির বিশ্লেষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত । কাল মার্কস এর সমাজতন্ত্র হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ।
মার্কস তাঁর ‘Das Kapital’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রের ব্যখ্যা করেন । মার্কস দরিদ্র ও শোষণে ভরা সমাজ থেকে শ্রমিকদের বিচ্ছিন করে আত্মসচেতন ও সংগ্রামমুখী বিপ্লবী করে তুলতে চেয়েছিলেন। মার্কস এর সমাজতন্ত্র ২ টি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হলো ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যখ্যা ও উদবৃত্ত মুল্যের তত্ত্ব।
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যখ্যা-
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যখ্যার উদ্দেশ্য হলো সমাজ ও ইতিহাসের একটি বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস তুলে ধরা। মার্কস সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরে বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতির নির্দশনকে তুলে ধরেছেন। মার্কস এর মতে , পারিপার্শিক অবস্থার বস্তুগত সত্তাই মানুষের ভাব ও চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে , মানুষের ভাব ও চেতনা বস্তুগত সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ।
বস্তুগত পরিবেশ বলতে মার্কস সমাজের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাকে বুঝিয়েছেন। খ্যাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান এই মৌলিক চাহিদার পরিতৃপ্তির জন্য মানুষকে বিশেষ ধরনের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হতে হয়, যাকে মার্কস অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলেছেন। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই মানুষের সামাজিক অবস্থানই মানুষের সামাজিক চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সাহায্যে মার্কস সমাজের পরিবর্তন ও বিবর্তনকে ব্যখ্যা করেছেন দাস সমাজ থেকে সভ্য সমাজ পর্যন্ত যে কোনো সমাজব্যবস্থাকে বাদ(Thesis) বলা যেতে পারে প্রচলিত সেই সমাজব্যবস্থা তাঁর অন্তনির্হিত কারন ও স্বভাবের জন্য এক বিরোধী শক্তিকে আকর্ষন করে প্রতিবাদ(Anti-Thesis) বলে। এবং এই বাদ ও প্রতিবাদ মিলে ভিন্ন এক সমাজ ব্যবস্থাকে গড়ে তোলে যাকে সাম্যবাদ বলে। এই সাম্যবাদ আবার বাদে পরিণত হয়ে একই ভাবে গড়ে উথেছে।এইভাবে চলে সমাজ ইতিহাসের পরিবর্তন ও বিবর্তন।
শ্রেণী বিভক্ত সমাজে যে শ্রেণী দ্বন্দ্ব দেখা যায় তা সামাজ পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি । শ্রেণী দ্বন্দ্বের ফলেই প্রত্যেক পর্যায়ের সমাজ এক উন্নততর ভিন্ন সমাজে পরিনত হয় ।
উদবৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব-
পন্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করা মূল্য ও পণ্যের বাজার মূল্য দ্বারাই উদবৃত্ত মূল্য উৎপন্ন হয় । পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হল যা কিছু উৎপাদিত হয় তা বাজারে বিক্রয়ের জন্যই উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত পণ্যের বাজারে যে বিনিময় মূল্য তা পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ের থেকে বেশি। উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে থাকে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি , প্রয়োজনীয় উপকরন ও শ্রমিকের মজুরি।
কোন পণ্যের বাজার মূল্য থেকে সেই পণ্যের উৎপাদন মূল্য বাদ দিলে যা থাকে তাকেই বলে উদবৃত্ত মূল্য । এই উদবৃত্ত মূল্যের সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি ব্যবধানের ভিত্তিতে স্থির হয় যে, শ্রমিক কতটা শোষিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা কেবল তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিনিয়োগ করেনা, অতিরিক্ত শ্রমের বিনিময়ে উদবৃত্ত মূল্যের পথ প্রসস্ত করে দেয়। এবং সেই উদবৃত্ত মূল্যের সবটাই শ্রমিকদের বঞ্চিত করে পুঁজিবাদীরা আত্মসাৎ করে।
মার্কস বলেছেন , শ্রমিকদের প্রতি এই বঞ্চনা দীর্ঘকাল ধরে চলতে পারেনা। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে একদিন সর্বহারা শ্রেণী সুসংগঠিত হয়ে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে অবতীর্ন হবে এবং তাদের উচ্ছেদ করে শ্রেণীহীন সমাজতন্ত্র গড়ে তুলবে।
সমালোচনাঃ
মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ সম্পূর্নভাবে ত্রুটি মুক্ত নয়।
প্রথমত, সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে অর্থনৈতিক উপাদান গুলির অবশ্যই ভূমিকা আছে। কিন্তু মার্কস ও তার অনুগ্রামীরা অর্থনৈতিক দিকটিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছেন, যা ইতিহাসের সঠিক বিবরণ নয় । পপার বলেছেন যে, অর্থনৈতিক সত্ত্ব নয় বরং অনান্য প্রগতিশীল প্রত্যয় দিয়েই সমাজের ব্যখ্যা করা যায়। কিন্তু মার্কসের তত্ত্বে এই দিকটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে ।
দ্বিতীয়ত, কোনো কোনো সমালোচক বলেন যে, মার্কস অর্থনৈতিক দূর দৃষ্টি সম্পন্ন হলেও রাজনৈতিক দূর দৃষ্টি সূক্ষ ছিল না। ফলে সমাজের শ্রমিক শ্রেণীর শোষণ বঞ্চনা তুলে ধরতে পারেননি।
তৃতীয়ত, মার্কস তাঁর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কেবল উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন পন্থা ইত্যাদির দিকের কথাই বলেছেন। কিন্তু উপাদানও যে সমাজ পরিবর্তনে বড়ো ভূমিকা পালন করতে পারে তা মার্কস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে উল্লেখ করেননি।
চতুর্থত, অনেকে অভিযোগ করেন যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজে স্বরূপ সম্পর্কে মার্কস স্পষ্ট ভাবে কিছু বলেননি তিনি কেবল সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে হেঁটেছেন, অথচ লক্ষ্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেননি।
পঞ্চমত, মার্কস যে সমাজতন্ত্রের পরিণত অবস্থা রূপে সাম্যবাদী উল্লেখ করেছেন , তা এক কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদে পরিণত হয়েছে, যা অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব অন্তর শুদ্ধির ফলে মানুষ একদিন দেবত্রে উন্নীত হবে এবং তখন আর রাষ্ট্রের প্রয়োজন থকবে না, এ এক কল্পনাশ্রয়ী মতবাদ আর কিছুই নয়।
পরিশেষে বলা যায়, মার্কস এর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের যতই অসংগতি ও ত্রুটি থাকুক না কেন একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সমাজে সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেণীর হতাশা শোষণ এবং তাদের ওপর অত্যাচারের যে ছবি তুলে ধরেছেন তা অতি জীবন্ত। তাদের এই অবস্থা থেকে মার্কস মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছিলেন।
Thanks For Reading: সমাজতন্ত্র কি । বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কি
প্রশ্ন উত্তর
১.বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কে?
উত্তর- বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হলেন কার্ল মার্কস ।
২. উদবৃত্ত মূল্য
উত্তর- পন্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করা মূল্য ও পণ্যের বাজার মূল্য দ্বারাই উদবৃত্ত মূল্য উৎপন্ন হয় ।
৩.C.E.M Joad সমাজতন্ত্রের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হল?
উত্তর-C.E.M Joad তাঁর ‘Introduction to Modern Political Theory’ গ্রন্থে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন “Socialism, In short is like a hat that lost it’s shape because everybody wears it.” ‘অর্থাৎ সংক্ষেপে সমাজতন্ত্র হল একটি টুপির মতো যা প্রত্যেকে পড়ার দরুন আকৃতি বদলে গেছে।’
আরো পড়ুন –
দেকার্তের মতে ধারণা কয় প্রকার ও কী কী
অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব
জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো
চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?