মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য

আধুনিক শিক্ষা হল শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা যেখানে শিক্ষক নয় , শিক্ষার্থীই শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষাপদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে যথা – মন্তেসরির শিক্ষা পদ্ধতি, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতি, প্রকল্প পদ্ধতি প্রভূতি । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হল মন্তেসরির শিক্ষা পদ্ধতি মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য(Characteristics of Montessori Education System) গুলি নিন্মে আলোচনা করা হল ।

মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য

 

মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতি | মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য

মন্তেসরির শিক্ষা প্রদ্ধতির প্রবর্তক হলেন ইতালীর ডাঃ মাদাম মন্তেসরি। ফ্রয়েবলের মতো তিনিও ইন্দ্রিয় পরিচালনার প্রশিক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শিশুর শিক্ষার জন্য মন্তেসরি যে  শিক্ষা প্রদ্ধতি প্রচলন করেন তা মন্তেসরির শিক্ষা প্রদ্ধতি নামে পরিচিতি। এই ধরণের শিক্ষা প্রদ্ধতি প্রচলনের উদ্দেশ্য তিনি ১৯০৭ সালে ‘ Casa – Dei Bambini বা ‘ শিশুনিকেতন ‘ প্রতিষ্ঠা করেন।

মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Montessori Education System

মন্তেসরির শিক্ষা প্রদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য অনুধারন করা যায়। বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

(i) স্বাধীনতা 

এই প্রদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল – শিশুকে অবাধ স্বাধীনতা প্রদান। এই প্রদ্ধতির মূল বক্তব্য হল শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর মনের পরিপূর্ন বিকাশ করতে হবে।  বাধা বা নিষেধ শিশুর অন্তনিহিত সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে চায় না। তাই পূর্ন স্বাধীনতার প্রয়োজন।

(ii) সক্রিয়তা 

শিক্ষা হবে শিশুর সক্রিয় প্রচেষ্টার দ্বারা গঠিত । অর্থাৎ শিশুকে যেন স্বাধীনভাবে হাতে কলমে কাজ করতে দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে মন্তেসরি ইন্দ্রিয় পরিমার্জনের উপযোগী বিভিন্ন ধরণের ডিড্যাকটিক যন্ত্রের প্রবর্তন করেন। সুতরাং এই প্রদ্ধতিতে স্বয়ং শিক্ষার নীতি বা Principal of self-Education কে  অনুসরণ করা হয়েছে।

(iii) ইন্দ্রিয় পরিচালনার প্রশিক্ষণ

মন্তেসরি শিক্ষার প্রদ্ধতিতে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্নেন্দ্রিয় উভয়ের পরিমার্জনের কথা বলেছেন। জ্ঞানেন্দ্রিয়ের জন্য বিভিন্ন ধরণের ডিড্যাকটিক যন্ত্র এবং কর্মেন্দ্রিয়ের জন্য বিভিন্ন ধরণের হাতের কাজ, শরীরচর্চা প্রভৃতি তার প্রদ্ধতিতে স্থান পেয়েছে। তাছাড়া সামাজিক উন্নতির জন্য পশু পাখির সেবা, বাগানের কাজ, প্রভৃতি কর্মেন্দ্রিয় নির্ভর কাজের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

(iv) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র 

মন্তেসরি প্রদ্ধতির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এই পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত বৈষম্যের তত্ত্ব অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র যাতে ক্ষুন্ন না হয় তার জন্য তিনি শ্রেণীকক্ষে দলগতভাবে পাঠদানের প্রদ্ধতিকে একেবারে স্থান দেননি। অ্যাডাম বলেছেন – ‘ The knell of class Teaching has been Rung ‘ আর সেই ঘণ্টা বাজিয়েছেন মন্তেসরি। তিনি বলেছেন শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণিবিভাগ থাকবে কিন্তু তা শিক্ষাদানের জন্য নয়, প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে।

(v) অধ্যাত্মিক সত্ত্বা ও মানসিক  সূত্রাবলী 

মন্তেসরির মতে সব শিশুই একটি আধ্যাত্মিক সত্ত্বা নিয়ে জন্মায়। শিশুর মানসিক বিকাশ কোন পথে অগ্রসর হবে। তা তার আধ্যাত্মিক সত্ত্বা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই আধ্যাত্মিক সত্ত্বার বিকাশ কতকগুলি মানসিক সূত্রকে অনুসরণ করে । সূত্রগুলি হল – সক্রিয়তার সূত্র, স্বনির্ভরতার সূত্র, মনোযোগের সূত্র, ইচ্ছার বিকাশ , বুদ্ধির বিকাশ, কল্পনা শক্তি ও সৃজনশীলতার বিকাশ। তাই মন্তেসরির মতে শিশুর শিক্ষা হবে আধ্যাত্মিক বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে।

(vi) শৃঙ্খলা 

গতানুগতিক শিক্ষা প্রদ্ধতিতে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু মন্তেসরি তাঁর প্রদ্ধতিতে দেখান শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুরষ্কার ও শাস্তির কোনটারই প্রয়োজন নেই। কারণ শাস্তি শিশুর দোষ দূর করে না , বরং নৈতিক অবনতি নিয়ে আসে। আর পুরষ্কার শিশুর মধ্যে ও অহংকার সৃষ্টি করে।

(vii) মনোবিজ্ঞানসম্মত 

মন্তেসরি প্রদ্ধতির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এই পদ্ধতিতে মনোবৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতির অনুসরণ করা হয়েছে। এই প্রদ্ধতিতে দেখা হয় শিশুর চাহিদা, আগ্রহ, মানুষিক সামার্থ্য ইত্যাদি মনোবৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য। এই মনোবৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্যর উপর ভিত্তি করে শিশুর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।

(viii) শিশু কেন্দ্রীকতা

এই প্রদ্ধতির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল শিশু কেন্দ্রীকতা। অর্থাৎ শিশুকে শিক্ষার কেন্দ্র করে তার চাহিদা ও সামার্থ্য অনুযায়ী প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়।

সীমাবদ্ধতা 

মন্তেসরি শিক্ষা পরিকল্পনার যথেষ্ট সফল্য লাভ করলেও এর কতকগুলো ত্রুটির প্রতি আধুনিক শিক্ষাবিদরা দৃষ্টি আকর্ষন করেছে-

প্রথমত 

এই প্রদ্ধতিতে শিশুরা শারীরিক স্বাধীনতা ভোগ করলেও তাদের মানসিক স্বাধীনতা বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ অর্থাৎ তারা স্বাধীনভাবে যেতে আসতে , কাজ করতে , বসে থাকতে পারলেও নিজেরা স্বাধীনভাবে নতুন কিছু সৃষ্টি করার সুযোগ পায় না।

দ্বিতীয়ত 

যে সব যন্ত্র শিশুদের কাজ করার জন্য দেওয়া হয়। সেগুলির সাথে শিশুর জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই।

তৃতীয়ত

মন্তেসরি প্রাচীন মনোবিজ্ঞানীদের মতে মানসিক শক্তির তত্ত্বের বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে মানসিক শক্তির তত্ত্ব সম্পর্ণ ভাবে বর্জিত হয়েছে।

সিদ্ধান্ত 

পরিশেষে বলা যায় যে, অনেক সীমাবব্ধতা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে মন্তেসরি প্রদ্ধতির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ন। শিশুরা যেহেতু স্বাধীনভাবে , ইন্দ্রিয় পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে , তাই শিশু শিক্ষার ইতিহাসে মন্তেসরি প্রদ্ধতি খুবই প্রসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।


প্রশ্ন উত্তর

১. মন্টেসরি পদ্ধতি কি?

উত্তর –  ইন্দ্রিয় পরিচালনার প্রশিক্ষণের উপর ভিত্তি করে ইতালীর ডাঃ মাদাম মন্তেসরি শিক্ষা প্রদ্ধতি প্রচলন করেন তা মন্তেসরির শিক্ষা প্রদ্ধতি নামে পরিচিতি।

২. মন্তেসরি প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের নাম কী?

উত্তর –  মন্তেসরি প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের নাম হল ‘ Casa – Dei Bambini বা ‘ শিশুনিকেতন ‘ (১৯০৭)।


আরো পড়ুন –

জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো

চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?

ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ

গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দলন

প্রশ্ন উত্তরে চার্বাক দর্শন


 

Leave a comment