আজকের দর্শন আলোচনা পর্বের আলচ্য বিষয় হল ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ( Origin and Development Of Indian Philosophy)। এই আলোচনায় আমরা প্রথমে দেখব যে ভারতীয় ও পাশ্চাত্ত্য দর্শনে ক্রমবিকাশের ধারা এবং তার পরে আলোচনা করা হয়েছে বেদ- উপনিষদ থেকে কী ভাবে ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে । আস্তিক ও নাস্তিক দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ একই ভাবে হয়নি , সেই বিষয়টির উপরে বিশেষ ভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ / (Origin and Development of Indian Philosophy)
ভারতীয় দর্শনের ক্রমবিকাশ এবং পাশ্চাত্ত্য দর্শনে ক্রমবিকাশ স্বতন্ত্র ধারায় অগ্রসর হয়েছে। পাশ্চাত্ত্য দর্শনের ইতিহাসে একের পর এক দার্শনিক মতবাদ আবির্ভূত হয়েছিল এবং একটি মতবাদের প্রভাব ও গুরুত্ব কমতে থকলে সে নতুন একটি দার্শনিক মতবাদ তার জায়গায় স্থান করে দেয়।
কিন্তু ভারতীয় দর্শনের ধারা আলোচনা করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন ভারতীয় দর্শনগুলি বিভিন্ন সময়ে উদ্ভুত হয়েও সুদীর্ঘকাল ধরে নিজ নিজ প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রেখে পাশাপশি বিরাজ করেছে।এই কারণেই আস্তিক এবং নাস্তিক, জড়বাদী এবং ভাববাদী, নিরীশ্বর এবং সেশ্বর সবরকম দার্শনিক মতবাদই একই সময়ে প্রচারিত হয়েছে এবং একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে; কিন্তু কোন দর্শনই এর জন্য নিজের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য হারায়নি।
ভারতীয় দর্শনের উদ্ভব চর্চা ও চর্যার সমন্বয়ঃ
ভারতীয় দর্শন নিছক তত্ত্বালোচনায় আবদ্ধ ছিল না, ভারতীয় দর্শনে চর্চা ও চর্যার সমন্বয় ঘটে। ভারতীয় দার্শনিকরা যে তত্ত্বের চর্চা করতেন সেই তত্ত্বকে চর্যা অর্থাৎ জীবনে প্রয়োগ করতেন। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনধারার সাথে ভারতীয় দর্শনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।এই জন্য ভারতীয় দর্শন সুদূর প্রাচীন কালে উদ্ভব হয়েও আজও সমান গতিতে অব্যাহত রয়েছে।
ভারতীয় দার্শনিকরা যে তাত্ত্বিক উপলব্ধি করতেন তা শুধু তত্ত্ব আকারেই সীমাবদ্ধ থাকত না, তারা তা জীবনে প্রয়োগ করতেন।এই জন্য একটি দার্শনিক মতবাদ গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার আনুগামি সমর্থকবৃন্দ সেই মতবাদের আদর্শ অনুযায়ী তাদের জীবনধারা পরিচালিত করত। যেমন- বৌদ্ধ দর্শনের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ যে আর্য্য সত্যের উপলব্ধি করে ছিলেন তা তিনি নিজের জীবনে প্রয়োগ করে ছিলেন এবং তার পরবর্তী আনুগামিগন তাদের জীবনে প্রয়োগ করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন ধারাকে আজও সমান ও স্বতন্ত্র ধারায় বজায় রেখেছেন।
বিভিন্ন ভারতীয় দর্শনের পারস্পরিক প্রভাব
ভারতে বিভিন্ন দর্শনগুলি একই সময়ে বিরাজ করার জন্য পারস্পরিক আলোচনা ও সমালোচনার দ্বারা পরস্পরের উপরে প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতীয় দর্শন প্রথমে পূর্ব পক্ষের মতবাদকে শ্রদ্ধাসহকারে জেনেছে এবং তার পরে প্রতিপক্ষের যে মতবাদ গুলি খণ্ডন করে নিজেদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করত। প্রতিটি দর্শনই অপরের অভিযোগগুলিকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে বিচার করে দেখত। এর ফলে প্রতিটি দর্শন তার নিজ বক্তব্যকে সুস্পষ্ট করার ও নিজের মতামতকে সুদৃঢ় করার সুযোগ লাভ করেছিল। ভারতীয় দর্শনগুলির ক্রমবিকাশের আলোচনায় ভারতীয় দর্শনগুলির এই পারস্পরিক প্রভাবের কথা বিশেষভাবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন।
বেদ ও উপনিষদকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দর্শনের উদ্ভব
ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তিকাল সঠিক ভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বেদ ও উপনিষদকে কেন্দ্র করেই যে ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারার প্রথম উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল, এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। বেদই ভারতের প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাধারার উৎস। তবে বেদের রচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিত মহল একমত নন। ম্যাক্সমুলার সম্পর্কে বিভিন্ন মত খ্রীঃ পূঃ ১২০০ থেকে ৬০০ বৎসরকেই বেদের রচনাকাল বলে নির্দেশ করেছেন। কারও কারও মতে এই রচনাকাল খ্রীঃ পুঃ ৪৫০০ থেকে ২৫০০ বৎসর। বুদ্ধ ও মহাবীরের আবির্ভাবের পূর্বে যে উপনিষদের চিন্তাধারার বিকাশ শুরু হয়েছিল, এ বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত।
রাধাকৃষ্ণণ তার ‘Indian Philosophy’- গ্রন্থে ভারতীয় দর্শনের বিকাশের কাল নির্ণয় প্রসঙ্গে চারটি পর্যায়ের কথা বলেছেন:
(১) বৈদিক যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ বৎসর)।
(২) মহাকাব্যের যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ২০০ অব্দ)।( রামায়ণ মহাভারত ছাড়াও বৌদ্ধ, জৈন, শিব)
(৩) সূত্র-যুগ (২০০ অব্দ থেকে এর শুরু)।
(৪) পাণ্ডিত্যের যুগ-এরও শুরু দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে। এই সময়েই শঙ্কর, রামানুজ, কুমারিল, শ্রধর, মাধব, বাচস্পতি, উদয়ন, ভাস্কর, জয়ন্ত, বিজ্ঞানভিক্ষু এবং রঘুনাথ প্রভৃতি পণ্ডিতদের আবির্ভাব ঘটে।
খ্রিষ্ট জন্মের প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে আর্যরা ভারতে এসেছিলেন। তার কিছুদিন পরে ঋক সংহিতার বিভিন্ন স্তোত্র রচিত হয়। ভারতবর্ষের দার্শনিক চিন্তার প্রথম সূত্রপাত হয় ঋক সংহিতায়। ঋক সংহিতায় যে দর্শন চর্চার সূচনা হয়ে ছিল তা আজও অব্যাহত ধারায় চলে আসছে।৪৮৭ খ্রিষ্ট পূর্বে বুদ্ধদেবে দেহ রক্ষা করে ছিল বলে পণ্ডিতদের মত। এই তারিখটিকে সীমানা করলে ভারতীয় দর্শনের দুটি স্তর পাওয়া যায় –
১. বৈদিক যুগের শেষ।
২. দর্শন সম্প্রদায়ের উদ্ভব
প্রথম স্তরটি ঋষিদের কাছে প্রতিভাত ছিল কিন্ত দ্বিতীয় স্তরটি থেকে ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের বিকাশ শুরু হয় । ভারতীয় দর্শনের দুটি ধারার কথা উল্লেখ করেছি-একটি আস্তিক দর্শন অর্থাৎ বেদানুগামী এবং অপরটি নাস্তিক, অর্থাৎ বেদবিরোধী। ভারতীয় আস্তিক দর্শনের বিকাশ শুরু হয় বেদ ও উপনিষদকে কেন্দ্র করে। বেদ ও উপনিষদকে কেন্দ্র করে ভারতীয় আস্তিক দর্শন সম্প্রদায়গুলি তিনটি স্তরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে –
১. সূত্র- গ্রন্থ
২. ভাষ্য-গ্রন্থ
৩ .টীকা-টিপ্পনী গ্রন্থ
১. সূত্র- গ্রন্থ
সূত্র কথার সাধারণ অর্থ হল সূতা।কিন্তু এখনে এর অর্থ হল – স্মৃতিসহায়ক। যেমন সুতা দিয়ে অনেক ফুলকে একটি মালায় গেঁথে রাখা যায়, একইভাবে এই সূত্রগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাগুলিকে একত্র সূত্র-গ্রথিত করা হয়।বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায় শ্রূতির মাধ্যমে গুরু শিষ্য দার্শনিক তত্ত্বকে প্রচার করতেন । কিন্তু দার্শনিক তত্ত্বকে লিখিত আকারে সংরক্ষিত করার জন্য সূত্রের জন্ম হল।
১. সাংখ্য দর্শন- মহর্ষি কপিল – সাংখসূত্র।
২. যোগ দর্শন- মহর্ষি পতঞ্জলি – যোগসূত্র।
৩. ন্যায় দর্শন- মহর্ষি গৌতম – ন্যায়সূত্র।
৪. বৈশেষিক দর্শন- মহর্ষি কণাদ – বৈশেষিকসূত্র।
৫. মীমাংসা দর্শন- মহর্ষি জৈমিনি – মীমাংসা সূত্র।
৬. বেদান্ত দর্শন- মহর্ষি বাদরায়ন – ব্রহ্মসূত্র।
২. ভাষ্য-গ্রন্থ
ভাষ্য হল সূত্রের গভীর ব্যাখ্যা। সূত্রগুলি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, সে কারণে সূত্রগুলির অর্থ সহজবোধ্য ছিল না। তাছাড়া একই সূত্রের একাধীক ব্যাখ্যা হওয়ায় সূত্রগুলির অর্থ বিভিন্ন হয়ে পরে । এই কারণে সূত্রগুলির অর্থ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য ভাষ্যকারের প্রয়োজন দেখা দিল।
সাংখ্যা সূত্রের উপর ভাষ্য
বাচস্পতি মিশ্র- তত্ত্ব কৌমুদী
গৌড়পাদ- সাংখ্যাকরিকা ভাষ্য
বিজ্ঞান ভিক্ষুর – সাংখ্য প্রবচন ভাষ্য
অনিরুদ্ধ- সাংখ্য প্রবচন সূত্রবৃত্তি।
যোগসূত্রের উপর ভাষ্য
বেদব্যাস- ব্যাস ভাষ্য
বিজ্ঞান ভিক্ষুর- যোগ বার্ত্তিক
ন্যায় সূত্রের উপর ভাষ্য
ব্যাৎসায়ন- ন্যায় ভাষ্য
উদ্দ্যোৎকর – ন্যায় বার্ত্তিক
বাচস্পতি মিশ্র- ন্যায় বর্তিক তাৎপর্য টিকা
জয়ন্ত ভট্ট- ন্যায় মঞ্জুরী
বৈশেষিক সূত্রের উপর ভাষ্য
প্রশস্ত পাদ- পদার্থ-ধর্ম-সংগ্রহ
মীমাংসা সূত্রের উপর ভাষ্য
শরর স্বামী- শবর ভাষ্য
ব্রহ্মসূত্রের উপর ভাষ্য
শংকরাচার্য- শারীরক কাব্য
রামানুজ- শ্রী ভাষ্য
নিম্বার্ক- বেদান্ত পরিজ্ঞাত সৌরভ
মাধব – মাধবভাষ্য
বল্লাভাচার্য- অনুভাষ্য
৩ . টীকা-টিপ্পনী গ্রন্থ
টীকা হল ভাষ্যের গভীর ব্যাখ্যা।পরবর্তী কালে আবার টীকার উপর টিকা লেখা হয় যা টিপ্পনী নামে পরিচিত।
- ভারতীয় আস্তিক দর্শনের ক্রমবিকাশর রূপটি হল- বেদ-উপনিষদ – মৌখিক- সূত্র- ভাষ্য- টিকা- টিপ্পনী।
ভারতীয় নাস্তিক দর্শনের ক্রমবিকাশ
ভারতীয় দর্শের নাস্তিক সম্প্রদায় গুলি হল – বৌদ্ধ, জৈন , ও চার্বাক। ভারতীয় নাস্তিক দর্শনের বিকাশ সূত্র রচনার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়নি, এর উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে বিভিন্ন উপদেশাবলির মধ্য দিয়ে। যেমন বৌদ্ধ দর্শন গড়ে উঠেছে গৌতম বুদ্ধের উপদেশাবলির মধ্য দিয়ে। আবার জৈন দর্শনরে উদ্ভব হয়েছে তীর্থাঙ্করদের উপদেশাবলির মধ্য দিয়ে।
কিন্তু চার্বাক দর্শন নাস্তিক হলেও তা আস্তকি ও নাস্তিক দর্শন বৌদ্ধ, জৈন এর বিরোধিতা করে গড়ে উঠেছে। এক কথায় বলা যায় চার্বাক দর্শন গড়ে উঠেছে আধ্যাত্মিকতার বিরধীতার মধ্য দিয়ে।
Thanks for Reading- ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
Read More: