ন্যায়মতে প্রত্যক্ষের লক্ষণ ব্যাখ্যা কর। নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষের মধ্যে পার্থক্য করো

ভারতীয় দর্শনের একটি আস্তিক দর্শন সম্প্রদায় হল ন্যায় দর্শন। এই অংশে আমরা ন্যায় দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো তা হল –ন্যায়মতে প্রত্যক্ষের লক্ষণ ব্যাখ্যা কর। নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষের মধ্যে পার্থক্য করো। এবং নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ স্বীকারে যুক্তি কি –এই প্রশ্নের উত্তরটিও এই অংশে আলোচনা করা হল।

ন্যায়মতে প্রত্যক্ষের লক্ষণ ব্যাখ্যা কর
ন্যায়মতে প্রত্যক্ষের লক্ষণ ব্যাখ্যা কর

 

ন্যায়মতে প্রত্যক্ষের লক্ষণ ব্যাখ্যা কর। নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষের মধ্যে পার্থক্য করো।

ন্যায় মতে, প্রত্যক্ষের লক্ষণ দাও।

মহর্ষি গৌতম ন্যায় সূত্রের প্রথম অধ্যায়ের চতুর্থ সূত্রে প্রত্যক্ষ প্রমাণের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন – “ ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষাপন্নং জ্ঞানম অব্যাপ্যদেশ্যম – অব্যভিচারি ব্যাবসায়াত্মকং প্রত্যক্ষম ” অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে সেই ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ জন্য যে অব্যাপাদেশ্য (অশাব্দ) , অব্যাভিচারী (অভ্রান্ত) ও ব্যবসায়াত্মক (নিশ্চয়াত্মক) জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাকে প্রত্যক্ষ বলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই লক্ষণটি জীবজ প্রত্যক্ষের লক্ষণ, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের লক্ষণ নয়, কারণ ঈশ্বরের ইন্দ্রিয় নেই।

লক্ষণে প্রদত্ত ‘ইন্দ্রিয়’ বলতে চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক – এই পাঁচটি বাহ্যরিন্দ্রিয় ও মন নামক অন্তঃরিন্দ্রিয়কে বোঝায় । ‘অর্থ’ বলতে বোঝায় ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়। ‘সন্নিকর্ষ’ পদটির অর্থ হল সম্বন্ধ। তবে যে কোন সম্বন্ধকে সন্নিকর্ষ বলা যায় না, ইন্দ্রিয়ের সাথে তার গ্রাহ্য বিষয়ের সম্বন্ধকে সন্নিকর্ষ বলা হয়। সুতরাং ইন্দ্রিয়ের সাথে বিষয়ের সন্নিকর্ষ জন্য যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাই হল প্রত্যক্ষ।

অনেক সময় দেখা যায় যে, ইন্দ্রিয়ের সাথে বিষয়ের সন্নিকর্ষ হলেও আমাদের জ্ঞান হয় না। তাই লক্ষণে কেবল ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষ বিশেষণটি প্রয়োগ করলে লক্ষণটি জ্ঞান ভিন্ন পদার্থে প্রত্যক্ষের লক্ষণটির অতিব্যাপ্তি বারনের জন্য ‘জ্ঞানম্‌’ পদটি ব্যবহার করা হয়েছে।

‘অব্যাপদেশ্যম্‌’ বলতে অশব্দ অর্থাৎ যে জ্ঞানকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। যে স্থলে ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষ ও শব্দ – এই উভয়ের জন্য জ্ঞান জন্মায়, তাকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলে না, শব্দ জ্ঞান বলে। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে শব্দ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। যেমন – ‘ঘট’ প্রত্যক্ষের সময় ঘট নাম পদটির সাথে পরিচিত বোধ না থাকলেও ঘটের প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়। সুতরাং শব্দ জ্ঞানের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অতিব্যাপ্তি দোষ বারনের জন্যই  মহর্ষি এই সূত্রে অব্যাপ্য দেশ্যম্‌ তৃতীয় পদটি বলেছেন।

অব্যভিচারী কথাটির অর্থ হল অভ্রান্ত। যা বস্তুত যে পদার্থ, তাকে সেই পদার্থ রূপে প্রত্যক্ষ করা হল অব্যভিচারী প্রত্যক্ষ। যেমন – রজ্জুকে রজ্জু বলে প্রত্যক্ষ করা। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে অব্যভিচারী হতে হবে। সুতরাং ভ্রম জ্ঞানে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের লক্ষনের অতিব্যাপ্তি দোষ বারনের জন্যই মহর্ষি সূত্রেই অব্যাভিচারী পদটি উল্লেখ করেছেন।

প্রত্যক্ষ জ্ঞান কেবল যথার্থ হলেই হবে না,তাকে নিশ্চিত হতে হবে। কারণ সংশয়াত্মক প্রত্যক্ষ ও অব্যভিচারী হয়। যেমন – দূর থেকে কোনো একটি দ্রব্য দর্শন করে,এটি কী- “ধূম অথবা এটি কি ধূলি” ?- এই স্থলে সংশয় জন্মায়। এইরূপ স্থলে জ্ঞানটিকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা যাবে না, কারণ এই স্থলে জ্ঞানের নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে নিশ্চিত হতে হবে। তাই মহর্ষি সূত্রে ব্যবসায়ত্মক পদটি ব্যবহার করে সংশয়াত্মক জ্ঞানের লক্ষনের অতিব্যপ্তি দোষ বারন করেছেন।


 


নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষের মধ্যে পার্থক্য কর।

ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষ থেকে যে জ্ঞানের উৎপন্ন হয় তাঁর স্পষ্টতা সব অবস্থায় সমান নয় । জ্ঞানের স্পষ্টতার স্তরভেদ অনুসারে প্রত্যক্ষ দুই প্রকার যথা- ১. সবিকল্পক প্রত্যক্ষ ও ২.  নিবিকল্পক  প্রত্যক্ষ ।  এই দুই প্রতক্ষের পার্থক্যগুলি নিম্নরূপঃ-

প্রথমত 

নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হল প্রাথমিক অনুভব । অর্থাৎ নির্বিকল্পকপ্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রথম স্তর।

অপরদিকে, সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হল পরিণত জ্ঞান। অর্থাৎ সবিকল্পক প্রত্যক্ষ পরবর্তী উন্নত স্তর।

দ্বিতীয়ত

নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হল অবিশিষ্টের জ্ঞান । অর্থাৎ এখানে বস্তু কী এবং কেমন। এসম্পর্কে বিশেষভাবে কোন কিছু জানা যায় না।

অপরদিকে, সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হল বিশিষ্টের জ্ঞান এখানে বস্তুকে বস্তু হিসাবে এবং বিশেষ বস্তু হিসাবে জানতে পারা যায়।

তৃতীয়ত

নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হল বস্তুর অস্তিত্বের জ্ঞান। এখানে বস্তুকে কিছু ‘একটা রয়েছে’ এইভাবে জানতে পারা যায় না।

কিন্তু , সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হল বস্তুর  স্বরূপের জ্ঞান । এই প্রত্যক্ষে বস্তুকে গুণযুক্ত বস্তুরূপে জানতে পারা যায়।

চতুর্থত

তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট বলেছেন- ‘নিঃপ্রকারকং জ্ঞানং নির্বিকল্পকম্‌’ অর্থাৎ নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হল নিঃপ্রকারক জ্ঞান। এক্ষেত্রে বস্তুর প্রকার হিসাবে নাম, গুণ, জাতি ধর্ম ইত্যাদির জ্ঞান হয়না।

অপরদিকে, অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে সবিকল্পক প্রত্যক্ষের লক্ষনে বলেছেন ‘সপ্রকারকং জ্ঞানং সবিকল্পকম’ অর্থাৎ সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হল সপ্রকারক জ্ঞান । এই প্রত্যক্ষে প্রকার হিসাবে বস্তুর নাম জাতি গুণ ধর্ম ইত্যাদির বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়।

পঞ্চমত

নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষে বস্তুকে বিশেষ্যরূপে এবং তাঁর গুণকে বিশেষ্যের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বিশেষণরূপে জানতে পারা যায় না। একটি লাল গোলাপের জ্ঞানের ক্ষেত্রে গোলাপটিকে লাল গোলাপ বলে জানা যায় না।

অপরদিকে, সবিকল্পক প্রত্যক্ষে বস্তুকে বিশেষ্যরূপে এবং তাঁর গুণকে বিশেষের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বিশেষণরূপে জানতে পারা যায়। এক্ষেত্রে গোলাপকে লাল গোলাপ হিসাবে জানতে পারা যায়।

ষষ্ঠত

নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হল অনিশ্চিত জ্ঞান। অপরদিকে, সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হল নিশ্চিত জ্ঞান।

সপ্তমত

নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ অব্যাপদেশ্য অর্থাৎ বচনের দ্বারা প্রকাশযোগ্য নয়। অপরদিকে, সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হল ব্যাপ্যদেশ্য অর্থাৎ এই প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে বচনের দ্বারা প্রকাশ করা যায়।

অষ্টমত

নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের অস্তিত্ব অনুব্যাবসায় বা মানুষ প্রত্যক্ষের দ্বারা সিদ্ধ নয় কারণ নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ্যে কোনোকিছু প্রকাররূপে ভাসমান হয় না। তাই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ অতিন্দ্রীয়।

অপরদিকে, সবিকল্পক প্রত্যক্ষের অস্তিত্ব অনুব্যবসায় বা মানুষ প্রত্যক্ষের দ্বারা সিদ্ধ। ‘এটা ঘট’- এই ব্যবসায় জ্ঞানকে বিষয় করে ‘আমি ঘটকে জানি’ এরূপ যে জ্ঞান তা অনুব্যবসায়। সবিকল্পক জ্ঞান মানুষ প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলে তা অতীন্দ্রিয় নয়।

 

 নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ স্বীকারে যুক্তি 

          নির্বিকল্পক স্তরে কোনো মানুষ প্রত্যক্ষ বা অনুব্যবসায় হয় না। এখানে প্রশ্ন উপস্থাপিত হয় যে, নির্বিকল্পক জ্ঞান স্বীকারে প্রমাণ কী ? এর উত্তরে অন্নংভট্ট ‘দীপিকা’ গ্রন্থে বলেছেন, নির্বিকল্পক জ্ঞান স্বীকারে অনুমানই একমাত্র প্রমাণ। সবিকল্পক জ্ঞানের উৎপত্তির জন্যই নির্বিকল্পক জ্ঞান স্বীকার করতে হয়।

সবিকল্পক জ্ঞান হল বিশিষ্ট জ্ঞান। বিশিষ্ট জ্ঞানের প্রতি বিশেষণের জ্ঞান হয় কারণ। যদি বিশেষণের জ্ঞান পূর্ব থেকে না থাকে তাহলে ওই বিশেষণের দ্বারা কোন বিশেষ্যকে বিশিষ্ট করা যায় না।  যেমন- দণ্ডি পুরুষের প্রত্যক্ষ সবিকল্পক । এখানে দণ্ডি হল পুরুষের বিশেষণ এই প্রত্যক্ষে দণ্ডের জ্ঞান পূর্ব থেকে না থাকলে দণ্ডি পুরুষের জ্ঞান হয় না।

একইভাবে ‘গোত্ব’ বিশেষণের জ্ঞান পূর্ব থেকে না থাকলে ‘এটা গরু’ এরুপ জ্ঞান হতে পারে না। ন্যায় মতে ‘দণ্ডি’, ‘গোত্ব’ এর জ্ঞান সবিকল্পক বা বিশিষ্ট হতে পারে না। এগুলি যদি বিশিষ্ট জ্ঞান হত তাহলে তার জ্ঞানের জন্য আর একটি বিশেষণের জ্ঞান স্বীকার করতে হবে এবং ওই জ্ঞানটিও বিশিষ্ট জ্ঞান হলে আবার আর একটি বিশেষণের জ্ঞান স্বীকার করতে হবে। এভাবে অমবস্থা দোষ দেখা দেবে। এই দোষ পরিহারের জন্য নৈয়ায়িকরা ‘গোত্ব বিশিষ্ট গো বাক্তি’ – সবিকল্পক জ্ঞানের পূর্বে ওই জ্ঞানের কারণরূপে গোত্বকে নির্বিকল্পক বলেছেন। অন্নংভট্ট তাই ‘দিপীকা’ তে বলেছেন – ‘বিশেষন জ্ঞানস্যাপি সর্বিকল্পকত্বে অনবস্থা প্রসঙ্গাৎ নির্বিকল্পক সিদ্ধঃ’।  


প্রশ্ন উত্তর 

১. ন্যায় দর্শন প্রত্যক্ষ কি?

উত্তর- ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে সেই ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ জন্য যে অব্যাপাদেশ্য (অশাব্দ) , অব্যাভিচারী (অভ্রান্ত) ও ব্যবসায়াত্মক (নিশ্চয়াত্মক) জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাকে প্রত্যক্ষ বলে।

২. ন্যায় মতে প্রমাণ কয় প্রকার ও কি কি? 

উত্তর –ন্যায় মতে প্রমাণ চারটি  প্রত্যক্ষ, অনুমান ,  উপমান এবং শব্দ। 

৩. প্রত্যক্ষ কয় প্রকার ও কি কি?

উত্তর – জ্ঞানের স্পষ্টতার স্তরভেদ অনুসারে প্রত্যক্ষ দুই প্রকার যথা- ১. সবিকল্পক প্রত্যক্ষ ও ২.  নিবিকল্পক  প্রত্যক্ষ


আরো পড়ুন –

জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো

চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?

ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ

গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দলন

প্রশ্ন উত্তরে চার্বাক দর্শন

জৈন স্যাদবাদ ব্যাখ্যা করো | সপ্তভঙ্গিনয়


 

Leave a comment