ভারতীয় দর্শনের একটি নাস্তিক দর্শন সম্প্রদায় হল জৈন দর্শন। জৈন দর্শনের একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ হল স্যাদবাদ। আমরা আজকে এই পর্বে আলোচনা করবো জৈন স্যাদবাদ ব্যাখ্যা করো এবং এ প্রসঙ্গে সপ্তভঙ্গিনয় ব্যাখ্যা করো।
জৈন স্যাদবাদ ব্যাখ্যা করো | সপ্তভঙ্গিনয়
জৈন স্যাদবাদ
জৈনদের মতে বস্তুমাত্রই অনন্ত ধর্মবিশিষ্ট। তারা বলেন সাধারন মানুষের লৌকিক জ্ঞান আংশিক, পূর্নাঙ্গ নয়। তাছাড়া স্থান-কাল ভেদে একই বস্তু সম্পর্কে অভিন্ন বা ভিন্ন ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান হতে পারে। লৌকিক জ্ঞান দেশকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং আংশিক মাত্র, কিন্তু প্রতিটি আংশিক জ্ঞানই সত্য। এই আংশিক জ্ঞান বা আপেক্ষিক জ্ঞানের অবধারণ বা বচনকেই ‘নয়’ বলে। প্রতিটি ‘নয়ই’ একপক্ষ বা একান্ত। ‘একপক্ষ বা একান্ত নয়’ কখনই বস্তুর পূর্নঙ্গ জ্ঞান দিতে পারে না, আংশিক জ্ঞান দেয়। তাই ‘নয়’ একান্ত বাদের দোষে দুষ্ট। তাই একান্তবাদকে পরিহার করে অনেকান্তবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য জৈনরা ‘স্যাৎবাদ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জৈনরা বলেন বস্তু সম্পর্কিত প্রতিটি ‘বচন’ বা ‘নয়’ শর্তাধীন হবে, কোন এক বিশেষ দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে, কোন এক বিশেষ অর্থে সত্য। জৈনরা বলেন প্রতিটি ‘নয়’ এই ‘স্যাৎ’ বিশেষণে বিষেশিত হওয়া দরকার। ‘স্যাৎ’ শব্দের অর্থ হল – ‘হতে পারে’ অর্থাৎ প্রত্যেক নয়েব পূর্বে যদি ‘স্যাৎ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তবে প্রত্যেক নয় আংশিক সত্য। হস্তীর পাদস্পর্শ করে কোন অন্ধব্যক্তি যদি ‘হস্তী স্তম্ভবৎ’ মনেকরে তাহলে একান্তবাদের দোষে দুষ্ট হবে। কিন্তু যদি ‘স্যাৎ’ শব্দ যুক্ত করে বলে যে, ‘স্যাৎ হস্তী সম্ভবৎ।’ তাহলে এটাই পরিস্ফুট হবে যে, শর্তাধীনভাবেই ‘স্তম্ভবৎ।’ হস্তী সম্পর্কে সমগ্রসত্য প্রকাশ করা হয়নি। এমন অবস্থায় উক্তিটিকে সত্যরূপে গ্রহণ করলে একান্তবাদের দোষে দুষ্ট হয়না। তাই লৌকিক জ্ঞান আপেক্ষিকভাবে সত্য, পূর্ন সত্য নয়।
জৈন দর্শন -এ ‘স্যাৎবাদ’ কে ‘কেবল’ অর্থে ব্যাখ্যা করে অনেক দার্শনিক সম্প্রদায় বলেন ‘স্যাৎবাদ’ হল ‘সংশয়বাদ’ ‘কেবল’ সকল জ্ঞানই মিথ্যা। কিন্তু জৈনরা এমন অর্থ করেননি, তারা বলেন কোন এক বিশেষ দৃষ্টি কোন থেকে বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান আংশিক সত্য পূর্নাঙ্গ মিথ্যা নয়। কোন এক দৃষ্টি কোন থেকে ‘কোন একটি ফুল, লাল বলে মনে হলে, সেই দৃষ্টিকোন থেকে ফুলটি লাল।‘ ফুলটি যে লাল তা এক দৃষ্টি কোন থেকে আংশিক সত্য পূর্নাঙ্গ মিথ্যা নয়। জৈনদের ‘স্যাৎবাদের’ দ্বার এই আংশিক লৌকিক জ্ঞানই প্রকাশ পেয়েছে। তাই জৈনদের ‘স্যাৎবাদ’ কে ‘সংশয়বাদ বলা যাবে।
জৈন সপ্তভঙ্গিনয়
জৈনরা তাদের ‘স্যাৎবাদ’কে সাতটি ‘নয়’ দ্বারা প্রকাশ করেছেন, এই সাতটি ‘নয়’ ‘সপ্তভঙ্গি নয়’ নামে পরিচিত। সাধারণ যুক্তি শাস্ত্রানুযায়ী বচন (জৈনমতে ‘নয়’) দুই প্রকার ইতিবাচক ও নেতিবাচক। ‘ইতিবাচক নয়’ দ্বারা কোন বস্তু সম্পর্কে কোন বিশেষ ধর্মকে স্বীকার করা হয় এবং ‘নেতিবাচক নয়’ দ্বারা কোন এক বস্তু সম্পর্কে কোন এক বিশেষ ধর্মকে অস্বীকার করা। এই দুই প্রকার বচন দ্বারাই জৈনরা তাদের ‘সপ্তভঙ্গি নয়’ কে ব্যাখ্যা করেছেন। এই সাতটি ‘নয়’ হল –
(i) স্যাৎঅস্তি
(ii) স্যাৎনাস্তি
(iii) স্যাৎঅস্তিচ স্যাৎ নাস্তি চ
(iv) স্যাৎ অব্যক্তম্
(v) স্যাৎ অস্তি চ অব্যক্তম্
(vi) স্যাৎ নাস্তি চ অব্যক্তম্
(vii) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অব্যক্তম্।
ঘটের দৃষ্টান্ত দিয়ে ‘সপ্তভঙ্গিনয়’ ব্যাখ্যা করা হয় –
১. স্যাৎ ঘটঃ অস্তি
হতে পারে কোন দেশ-কাল-অবস্থায় ঘট বিদ্যমান। কুম্ভকারের ঘট সৃজনের পর ঘট অস্তিত্বশীল।
২. ‘স্যাৎ ঘটঃ নাস্তি’
হতে পারে কোন দেশ কাল অবস্থায় ঘট বিদ্যমান নেই। কুম্ভকারের ঘট সৃজনের পূর্বাবস্থায় ঘট অবিদ্যমান।
৩. ‘স্যাৎ ঘটঃ অস্তি চ নাস্তি চ’
হতে পারে কোন দেশ কাল অবস্থায় ঘট বিদ্যমান এবং অন্য কোন দেশকাল অবস্থায় ঘট অবিদ্যমান। ঘট সৃজনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থাকে পর্যায় ক্রমে বিশ্লেষণ করলে ঘট অস্তিত্বশীল ও নাস্তিত্বশীল।।
৪. ‘স্যাৎ ঘটঃ অব্যক্তম্’
হতে পারে কোন দেশ কাল অবস্থান ঘট অবর্ননীয়। ঘট সৃজনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থাকে সংযুক্তভাবে বিশ্লেষণ করলে ঘট অবর্ননীয়।
৫. ‘স্যাৎ ঘটঃ অস্তি চ অব্যক্তম্’
হতে পারে কোন দেশ কাল অবস্থায় ঘটের বিদ্যমানতা অবর্ননীয়। ঘট সৃজনের পরবর্তী অবস্থান ঘট অস্তিত্বশীল এবং ঘট সৃজনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থাকে সংযুক্তভাবে বিশ্লেষণ করলে ঘট অবর্ননীয়।
৬. ‘স্যাৎ ঘটঃ নাস্তি চ অব্যক্তম্’
হতে পারে কোন দেশ কাল অবস্থায় ঘটের অবিদ্যমানতা অবর্ননীয়। ঘট সৃজনের পূর্ববর্তী অবস্থায় ঘট অবিদ্যমান এবং ঘট সৃজনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থাকে সংযুক্তভাবে বিশ্লেষণ করলে ঘট অবর্ননীয়।
৭. ‘স্যাৎ ঘটঃ অস্তি চ নাস্তি চ অব্যক্তম্’
হতে পারে কোন দেশ কাল অবস্থায় ঘটের বিদ্যমানতাও অবিদ্যমানতা অবর্ননীয়। ঘট সৃজনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থাকে সংযুক্তভাবে বিশ্লেষণ করলে ঘট ‘অব্যক্তম্’ এবং পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করলে ঘট বিদ্যমান ও অবিদ্যমান।
এইভাবে জৈন দর্শন- এ ‘সপ্তভঙ্গী নয়ের’ সাহায্য তাদের বস্তু সম্পর্কিত বচন বা অবধারণকে ব্যাখ্যা করেছেন।
Thanks For Reading : জৈন স্যাদবাদ ব্যাখ্যা করো | সপ্তভঙ্গিনয়
প্রশ্ন-উত্তর
১. জৈন ধর্ম প্রচার করেন কে?
উত্তর- জৈন ধর্ম প্রচার করেন মৌর্য রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তিনি কর্ণাটকে জৈন ধর্ম প্রচার করেন ।
২. মহাবীরের মূল শিক্ষা কি ছিল?
উত্তর- মহাবীরের মূল শিক্ষা হল অহিংসা, সত্য, অস্তেয় , ব্রহ্মচর্য , অপরিগ্রহ। এই পাঁচটি পথ হল মোক্ষ লাভের উপায় স্বরূপ।
৩. প্রথম জৈন তীর্থঙ্করের নাম কি?
উত্তর- প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর হলেন ঋষভনাথ।
৪. জৈন ধর্মের শেষ তীর্থঙ্কর এর নাম কি?
উত্তর- জৈন ধর্মের শেষ তীর্থঙ্কর এর নাম হল চব্বিশতম তথা শেষ তীর্থংকর ছিলেন মহাবীর।
৫. জৈন ধর্মের তীর্থঙ্কর কতজন?
উত্তর- জৈন ধর্মের তীর্থঙ্কর হলেন ২৪ জন।
আরো পড়ুন –
জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো
চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?
ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ