ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ

ভারতীয় দর্শন হল আধ্যাত্মবাদী দর্শন। সুদূর প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় মুনি ঋষিদের কঠোর সাধনার ফলশ্রুতি হল  Indian Philosophy । চার্বাক দর্শন ছাড়া  সকল ভারতীয় দর্শন হল আধ্যাত্মবাদী। আধ্যাত্মবাদ অনুসারে অত্মাই হল পরমতত্ত্ব। তাই অত্মাকে উপলব্ধি করাই হল ভারতীয় দর্শনের মূল লক্ষ্য।

এই আলোচনার মাধ্যমে পাঠক বন্ধুরা ভারতীয় দর্শনে দর্শন শব্দের অর্থ (The Meaning Of the Term Darsana) সহজে বুঝতে পারবেন। তাছাড়া  পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ (WBCHSE) একাদশ শ্রেনীর দর্শন এ  Semester  ভিত্তিতে যে সিলেবাস নির্মান করছে তার Unit-I এর Introduction to Indian Philosophy তে রয়েছে ভারতীয় দর্শনের পরিচয়।  তাই একাদশ শ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রীদেরও বিশেষ উপকারে আসবে।

 

Indian Philosophy
Indian Philosophy

  ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy 

ভারতীয় দর্শনের উদ্ভব 

পাশ্চাত্য দর্শন শুরু হয়েছিল জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ থেকে বা জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থেকে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগের সহজ, অর্থ হল সমস্ত কিছুকে জানার আগ্রহ বা ইচ্ছা। প্রাচীন কাল থেকে এই প্রকৃতি মানুষের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে। মানুষ প্রকৃতিকে জানার আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। আর এই জানার আগ্রহ থেকেই পাশ্চাত্য দর্শনের শুরু হয়। তাই বলা হয় তত্ত্ব জ্ঞান লাভ করাই পাশ্চাত্য দর্শনের একমাত্র লক্ষ্য।

কিন্তু ভারতীয় দর্শন কেবলমাত্র জানার আগ্রহ থেকে সৃষ্টি হয়নি। ভারতীয় দর্শন সৃষ্টি হয়েছে জীবনের প্রয়োজন বোধ থেকে। এখন প্রশ্ন হল জীবনের প্রয়োজন বোধ গুলি কী ?

এর উত্তরে বলা যায় মানুষের জীবনে প্রয়োজনের অন্ত নেই। কামনা বাসনার শেষ নেই। এক কামনা বাসনা শেষ হতে না হতেই অপর কামনা বাসনা এসে হাজির হয়। মানুষের জীবনে সকল কামনা বাসনাকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। এই চারটিকে একত্রে পুরুষার্থ বলা হয়। পুরুষার্থ হল মানুষের কাম্য বিষয় ।

ধর্ম (Dharma):

সাধারণ অর্থে বা লৌকিক অর্থে ধর্ম হল ঈশ্বরের পূজাঅর্চনা করা। ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সামাজিক রীতি নীতি ও অনুষ্ঠান পালন করা। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে ধর্ম হল যা ধারণ করে , প্রতিটি বস্তুকে নিজস্বগুনে ধরে রাখে। মানুষকে সৎ কর্মে ধরে রাখে। কিন্তু ধর্ম  পথে কাম্য বস্তু লাভ হয়। তাই ধর্ম প্রকৃত বা চরম সৎ বা সত্য নয়, ধর্ম মোক্ষ লাভের মহায়ক।

অর্থ (Artha):

কাম্য বস্তু লাভ করা যায় যা দিয়ে তাহল অর্থ। অর্থ পার্থিব বস্তু। তাই অর্থ মানুষের পরম কাম্য বস্তু বা পরম প্রয়োজনীয় বিষয় নয়। তাই অর্থ প্রকৃত সত্য। অর্থ মানুষকে যে সুখ দেয় তা স্থায়ী নয়, ক্ষনিকের সুখ। আবার অর্থের অভাবে মানুষের দুঃখও উৎপন্ন হয়, এই দুঃখও চিরস্থায়ী নয়। অর্থ একটি ক্ষণিক বিষয় তাই প্রকৃত সত্য হতে পারে না।

কাম (kama):

যেকোন ধরণের সুখ লাভের প্রবৃত্তি হল কাম। তবে লৌকিক ভাবে  যৌন প্রবৃত্তিকে কাম বলা হয়ে থাকে। সুখ মানুষের জীবনের লক্ষ্য নয়, কারণ সুখ হল ক্ষণস্থায়ী। জৈবিক প্রবৃত্তির বশে মানুষ যে সুখ কামনা করে তা ক্ষণস্থায়ী ও দুঃখমিশ্রিত। এই জাগতিক কোন সুখই পরিপূর্ন সুখ হতে পারে না, কারণ তাতে কিছুই দুঃখ মিশ্রিত থাকে। তাই কাম মানুষের জীবনে চরম সত্য নয়।

মোক্ষ :

মোক্ষ কথার অর্থ হল মুক্তি বা দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি। সহজ কথায় দুঃখের চিরতরে নাশ করাই হল মোক্ষ। দুঃখের চিরবিনাশ হলে আর মানুষের কোন কিছুই কামনা করার থাকে না। তাই মোক্ষ পরম পুরুষার্থ।

মোক্ষ লাভ হল আত্মজ্ঞানের দ্বারা বা আত্মাকে সাক্ষাৎ দর্শন।আত্মা হল জগতের প্রকৃত সৎ বা সত্য। আর এই সত্যের উপলব্ধিই হল দর্শন। সুতরাং জগতে প্রকৃত সত্যের সাক্ষাৎ উপলব্ধি থেকেই ভারতীয় দর্শনের সৃষ্টি।

দর্শন শব্দটির ব্যুৎপত্তি অর্থ:

সংস্কৃত ‘দৃশ’ ধাতু থেকে দর্শন শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে। ‘দৃশ’ ধাতুর উত্তর ‘অনট্‌’ প্রত্যয় করে। দর্শন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। দৃশ + অনট্‌ = দর্শন ‘দৃশ’ ধাতুর অর্থ হল দেখা। কাজেই ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে দর্শন শব্দটির অর্থ হল দেখা বা প্রত্যক্ষ করা।

কিন্তু যে কোন দেখাকেই দর্শন বলা যায় না, দর্শন হল আত্মাকে দেখা। আত্মাকে দেখা হল আত্মাকে উপলব্ধি করা। এই জগতের প্রকৃত সত্য হল আত্মা। তাই আত্মার সাক্ষাৎ উপলব্ধিই হল দর্শন।

  দর্শন হল চর্চা ও চর্যার সমন্বয় :

মানুষের চেতনার দুটি দিক আছে, একটি হল চর্চা (জানা) এবং অপরটি হল চর্যা (করা) । ভারতবর্ষে  দর্শন কথাটির মধ্যে চর্চা ও চর্যা এই দুটির সমন্বয় উঠেছে। ভারতবর্ষে দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য হল তত্ত্বজ্ঞানকে উপলব্ধি করা (চর্যা) এবং সেই উপলব্ধিকে আচরণে পরিণত করা। অর্থাৎ বিচারের সঙ্গে আচরণের সমন্বয় সাধন করাই ভারতীয় দর্শনের মূল লক্ষ্য। জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন জ্ঞানের কথা ভারতবর্ষের দর্শনে বলা হয় না।

 দর্শন বুদ্ধিজাতজ্ঞানকে বোধে উন্নীত করে :

ভারতীয় মতে দর্শন আলোচনায় জ্ঞান দুই প্রকার পরাজ্ঞান ও অপরাজ্ঞান। পরাজ্ঞান হল সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান যা দিয়ে আত্মার দর্শন বা উপলব্ধি হয়। অপরাজ্ঞান হল বুদ্ধির সাহায্যে জগৎ বিষয়ক জ্ঞান । জগৎ বিষয়ক জ্ঞান পরম সৎ নয় । তাই অপরাজ্ঞানের সাহায্যে পরম সৎ বা আত্মাজ্ঞান লাভ করা যায় না। প্রমাণ শাস্ত্রের দ্বারা প্রমেয় বা আত্মাজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

Conclusion:

অসংখ্য ধন্যবাদ সকল দর্শন অনুরাগীকে ভারতীয় দর্শন(Indian Philosophy) । এর ভূমিকা অংশ মনোযোগ সহকারে পাঠ করার জন্য। সকল ছাত্র-ছাত্রীদেরও পরীক্ষা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে উপকারে এলে আমাদের পরিশ্রম সফল হবে।

 

প্রশ্ন-উত্তর:

১. ভারতীয় দর্শনে দর্শন শব্দের অর্থ কী?

উত্তর – ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে দর্শন শব্দটির অর্থ হল দেখা বা প্রত্যক্ষ করা। কিন্তু যে কোন দেখাকেই দর্শন বলা যায় না, দর্শন হল আত্মাকে দেখা।

২.  ভারতীয় দর্শনের অপর নাম কি?

উত্তর- ভারতীয় দর্শনের অপর নাম হল আধ্যত্ম্যবাদী দর্শন বা মোক্ষবাদী দর্শন।

৩.  ভারতীয় দর্শনের জনক কে?

উত্তর- ভারতীয় দর্শনের জনক হলেন শঙ্করাচার্য যিনি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ।

৪. ভারতীয় দর্শনের দুটি বৈশিষ্ট্য কী?

উত্তর ১. ভারতীয় দর্শন হল  দর্শন হল চর্চা ও চর্যার সমন্বয়। ২. ভারতীয় দর্শন হল দর্শন বুদ্ধিজাতজ্ঞানকে বোধে উন্নীত করে।

৫. দর্শন ও Philosophy এর মধ্যে পার্থক্য কী?

উত্তরঃ ভারতীয় দর্শন হল   আত্মাকে দেখা বা আত্মার সাক্ষাৎ উপলব্ধিই হল দর্শন। এবং  Philosophy হল জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা।

৬. ভারতীয় দর্শন কী হিন্দু দর্শন ?

উত্তরঃ হিন্দু ধর্ম গড়ে উঠেছে সনাতন ধর্মকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ভারতীয়  দর্শন কেবল সনাতন ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি, ভারতীয়  দর্শনে বৌদ্ধ , ইসলাম , জৈন ইত্যাদি সকল ধর্মকে স্থান দেওয়া হয়েছে। তাই ভারতীয় দর্শন কেবল হিন্দু দর্শন নয়।

৭.  বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তরঃ বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়ের লক্ষ্য হল প্রকৃত সত্যের সন্ধান করা।  তবে প্রকৃত সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞান ও দর্শন ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। বিজ্ঞানের প্থ হল পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ।  কিন্তু দর্শনের প্থ হল কঠোর আধ্যাত্মিক যোগ সাধনা।

Read More:

  1. গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দলন

 

Leave a comment