প্রিয় পাঠক আজকের বাংলা রচনা পর্বে যে রচনাটি আমরা উপস্থাপন করতে চলেছি তা হল-নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু রচনা। মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যামিক শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপনা , নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু জীবনী । এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর রচনা তোমরা পেয়ে যাবে এই পেজে ,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু রচনা class 6/7 ।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু রচনা
সূচনা :
“ভারত মায়ের অগ্নি শিশু তুমি
বীর নেতাজী” -লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।
পরাধীন ভারতের মুক্তিমন্ত্রের সাধক এবং জাগ্রত যৌবনের প্রতীক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একজন সংগ্রামী নায়ক। বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আদর্শের ছায়ায় প্রতিপালিত সুভাষচন্দ্র শৌর্য-বীর্য-ত্যাগের মূর্ত বিগ্রহ। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ উপন্যাসের সব্যসাচী কল্পনার জগৎ থেকে যেন বাস্তবে নেমে এসেছেন। সব্যসাচী যেন সুভাষচন্দ্রের পূর্বগামিনী ছায়া। দুর্গম পথের অভিযাত্রী । দুঃসাধ্যের সাধক , কোন পার্থিব ভোগসুখ তাঁকে ব্রতভ্রষ্ট করতে পারেনি । তিনিই ছিলেন পরাক্রমী ,নির্ভীক , ভারতবাসীর আদর্শ দেশনেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ।
জন্ম ও বংশপরিচয় :
ওড়িশার কটক শহরে ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি , পরাধীন ভারত জননীর এক রাজদ্রোহী অগ্নি-শিশু সুভাষচন্দ্রের জন্ম। পিতার নাম জানকীনাথ বসু ছিলেন একজন সরকারি আইনজীবী। তাঁর মাতার নাম প্রভাবতী দেবী ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিণী।
শিক্ষা জীবন :
কটক শহরেই নেতাজির পাঠ্যজীবন শুরু হয় । কটক র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সুভাষচন্দ্র প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। এর পর তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক ওটেনের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। ছাত্রদের হাতে প্রহৃত হন ওটেন এবং সুভাষচন্দ্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে স্যার আশুতোষের চেষ্টায় স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে অনার্সসহ তিনি বি.এ. পাশ করেন তিনি।
১৯২০ সালে আই. সি.এস. পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান দখল করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাইপোজ পরীক্ষাতেও তিনি উত্তীর্ণ হন। কিন্তু এই সময় তাঁর দেশানুরাগী হৃদয়ে দেশাত্মবোধের জাগরণ , তাই তিনি সিভিল সার্ভিস প্রত্যাখান করে দেশে ফিরে আসেন ।
দেশসেবায় আত্মনিয়োগ :
ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরেই শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ও দেশ সেবার দুশ্চর ব্রত । সেই সময় ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গান্ধীজীর নেতৃত্বে সারাদেশে শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতি। কিন্তু গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের কর্মসূচি সুভাষচন্দ্রকে খুশি করতে পারেনি। তুলনায় দেশবন্ধুর ‘স্বরাজ্য পাটি’ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে।
দেশবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর তারুণ্য,যৌবনের প্রাণ, প্রাচুর্য , কর্মশক্তি , সংগঠনী ক্ষমতা ,চারিত্রিক দৃঢ়তা , নেতৃত্বদানের বিস্ময়কর ক্ষমতা চিত্ররঞ্জন দাসকে অভিভূত করে । সুভাষচন্দ্র গড়েন এক শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক দল । তাঁর জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা দেখে ইংরেজ সরকার ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে বারংবার নিক্ষেপ করেন কারান্তরালে ।
কর্মজীবন :
সুভাষচন্দ্র কর্মজীবন ছিল রাজনীতিক, কিন্তু দেশের গঠনমূলক সমস্ত কাজে সে যুগে তাঁর ছিল অগ্রনায়কের ভূমিকা। ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে ভারত পরিদর্শনরত ইংল্যান্ডের যুবরাজের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জনের জন্য হরতাল পালনের সূত্রে দেশবন্ধুর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রও কারাগারে বন্দী হন।
মুক্তিলাভের পর দেশবন্ধুর ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার সম্পাদক হন তিনি। ১৯২৪ সালে কলকাতা করপোরেশনের প্রধান কর্মাধ্যক্ষ হয়ে তিনি কলকাতা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রকাশ করেন। বিপ্লবীদের সঙ্গে সংস্রব রাখার কল্পিত অভিযোগে সুভাষ কারারুদ্ধ হলেন। ১৯২৯-এর লাহোর কংগ্রেসে বিপ্লবপন্থার সমর্থক বলে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। গান্ধীজীর আহ্বানে লবণ সত্যাগ্রহ করে আবার তিনি জেলে যান।
১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র যথাক্রমে হরিপুরা ও ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে বিরোধের ফলে কংগ্রেস ছেড়ে তিনি ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করলেন। সুভাষের সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪০ সালে নিজের বাড়িতে তাঁকে অন্তরীণ করে রাখে।
দেশত্যাগ ও আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন :
১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে অন্তর্ধান করে ছদ্মবেশে কাবুল, রাশিয়া, বার্লিন হয়ে জাপানে পৌঁছন। সেখানে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পরামর্শে জাপান সরকারের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে তিনি গঠন করলেন ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’।
ক্যাপ্টেন মোহন সিং এর হাতে ১৫ ই ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পতন । জাপান সরকারের বন্দী ভারতীয়দের দায়িত্ব অর্পণ । স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সমিতি গঠন করেন এবং সেই সমিতির সভাপতি পদে আসীন হন রাসবিহারী বসু , সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করেন মোহন সিং-এর হাতে । পরে সুভাষচন্দ্র টোকিও পৌঁছালে ১৯৪৩ এর ২৫ শে আগস্ট আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হলেন সবার প্রিয় নেতাজি।
নেতাজীর আহ্বান :
১৯৪৪ সালের ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি রেঙ্গুন থেকে শুরু হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান । তিনি আবেগদীপ্ত কণ্ঠে বলেন ওই নদীর ওপারে অরণ্য, পর্বত শেষে আমাদের চিরবাঞ্ছিত দেশ , আমাদের জন্মভুমি । শোন ভারতবর্ষ আমদের ডাকছে । ভারতের রাজধানী দিল্লী আমাদের ডাকছে ,আত্মীয় ডাকছে আত্মীয়কে । ওঠ আর সময় নেই । অস্ত্র ধর ।
আজাদ হিন্দ ফৌজের উদ্দেশ্যে তিনি উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেন – “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো”। ভারত সীমান্তের সবচেয়ে কাছের ব্রিটিশ ঘাঁটি মোডক মেজর রাতুরি আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন , শত্রু সৈন্য পিছু হটল।
১৯৪৫ সালের ১৯ মার্চ ‘দিল্লী চলো’ ও ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনির উন্মাদনা জাগিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতে ঢুকে স্বাধীন জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে ইংরেজ ব্রহ্মদেশ দখল করল , এবং জাপানের আত্মসমর্পণের ফলে আজাদ হিন্দ সরকারের পতন ঘটে।
উপসংহার :
১৯৪৫ সালে টোকিও যাত্রার পথে ফরমোজা দ্বীপে এক বিমান-দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয় বলে মনে করা হয়। কিন্তু ভারতবাসী আজও তা মানতে নারাজ । পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যারা তাঁকে পরাভূত করে । এমন কোন বন্দিশালা নেই যেখানে তাঁকে বন্দী রাখা যায় । আজও ভারতবাসীর শ্রদ্ধার আসনে তিনি প্রতিষ্ঠিত । নেতাজীর অভাব বেদনায় কাতর ভারতবাসীর অন্তর আজও বলে –‘তোমার আসন শুন্য আজি হে বীর পূর্ণ করো ’।
অভ্রান্ত দূরদৃষ্টির সঙ্গে সংকল্পের দৃঢ়তা তাঁকে অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর ‘রাত্রির তপস্যা’ প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীন দিনের সূচনা করেছে। নেতাজী নিজেই যেন এদেশের ‘তরুণের স্বপ্ন’, মৃত্যুঞ্জয়ী , স্বাধীনতার এক জ্বলন্ত মশাল ।
Thanks For Reading : নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু রচনা
■ অনুরূপ প্রবন্ধ:
একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক
নেতাজী জন্মশতবর্ষ জীবন
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী
আমার প্রিয় দেশনেতা
আরো পড়ুনঃ