রামকৃষ্ণ পরমহংস

প্রিয় পাঠক আজকের বাংলা রচনা পর্বে যে রচনাটি আমরা উপস্থাপন করতে চলেছি তা হল-রামকৃষ্ণ পরমহংস   মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যামিক শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপনা, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনী। এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর রচনা তোমরা পেয়ে যাবে এই পেজে ,  রামকৃষ্ণ রচনা

রামকৃষ্ণ পরমহংস
রামকৃষ্ণ পরমহংস

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস

 ভূমিকা : 

ঊনিশ শতকে ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালির চোখে সনাতন হিন্দু-ধর্মের দোষ-ত্রুটি বড় হয়ে ওঠে এবং সদ্য-প্রচারিত ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনেকের আনুগত্য দেখা যায়। সমাজ জীবনের এমনি এক সন্ধিক্ষণে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব। মানবতাবাদের সাধনা ছিল যার মহৎ জীবনব্রত , এক যুগ সন্ধিক্ষণে অন্ধ তামসিকাতর আবরণ ভেদ করে জ্যোতির্ময় বিগ্রহ রূপে যার উদার অভ্যুদয় । অমৃতবাণীর উদ্গাতা , সর্বধর্ম সমন্বয়ের মহাতাপস, পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ ।

আবির্ভাব বাল্যকাল : 

১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত কামারপুকুর গ্রামে রামকৃষ্ণের জন্ম হয় । তাঁর পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম চন্দ্রমণি দেবী। বাল্যকালে রামকৃষ্ণের ডাকনাম ছিল গদাধর।

চরিত্র :  

গদাধরকে গ্রামের সকলে খুব স্নেহ করতেন । পড়াশুনোর চাইতে যাত্রাগান, কথকতার প্রতিতীর অনুরাগ ছিল বেশি। ভক্তিমূলক গান এবং ঠাকুর দেবতার কথা তিনি একবার শুনেই মনে রাখতে পারতেন। মাটির মূর্তি বানাতে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। রামায়ণ, মহাভারত ও ভগবতের অনেক কথা তাঁর ছোটবেলাতেই মুখস্থ ছিল এবং তখন থেকেই তাঁর ভাব সমাধি হত।

সাধু সঙ্গ : 

শৈশব থেকে গদাধর দেখেছেন বহু ভক্ত প্রাণ মানুষকে , কামার পুকুরের ওপর দিয়ে কত তীর্থ যাত্রীর নিত্য আনাগোনা । শ্রীক্ষেত্র দর্শনের আকুতি নিয়ে চলে ভক্তের দল । সেই সময় তাদের পর্ণ কুঠিরেও কত রুগ্ন , দীন-দুঃখী , অসমর্থ তীর্থ যাত্রীর ভিড় । এখান থেকে কেউ অভুক্ত অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না । তাঁর ধর্ম প্রাণ পিতা সর্বস্ব দিয়ে অতিথিদের সেবা করতেন । সাধু সঙ্গ বালকের মনকে গভীর ভাবরসে ভরিয়ে দেয় । মন ছুটে চলে কোন সুদূরে অভিসারে , তখন থেকেই মনের মধ্যে অন্তরের হাতছানি , কালে কালে তারই বহিঃপ্রকাশ ।

কলকাতায় আগমন :  

পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব পড়ল অগ্রজ রামকুমারের  উপর । নানান শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন রামকুমার । পারিবারিক দৈন্য দুর্দশা দূর করতে অর্থ উপার্জনের জন্য রামকুমার কলকাতায় আসেন। পরবর্তীকালে বিদ্যাভ্যাসে প্রবল অমনোযোগী গদাধরের জীবন ধারা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল , তাই তিনি তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এলেন, পড়াশোনার ওপর তাঁর তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মেছিল, নিয়মমাফিক বিদ্যাকে তিনি “চাল কলা বাঁধা বিদ্যা” বলে উপহাস করতেন।

দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ : 

১৮৫৫ সালের ৩১ মে রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে শ্রী শ্রী ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই মন্দিরের পূজারীর পদে নিযুক্ত হলেন উদার স্বভাবের, শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন রামকুমার। পৈৗরোহিত্যের কাজে দাদাকে সাহায্য করার জন্য সঙ্গে এলেন গদাধর। পরবর্তীকালে এই দক্ষিণেশ্বরই হয়ে উঠেছিল তাঁর সাধনার প্রধান পীঠস্থান ।

পূজাপাঠ, ধ্যান, কলকাতায় ও শাস্ত্রকথা এসব গদাধরের ভাল লাগত। পবিত্র গঙ্গা নদীর তীরে শান্ত নির্জন পরিবেশে  এই দেবালয়। সেখানে থাকাকালীন গদাধরের মনে এল অন্য এক ভাবন্তর , পূজা অর্চনা স্তব-পাঠে তিনি মন দিলেন ,যজন যাজনে তিনি দাদকে সাহায্য করতেন তিনি । কিন্তু আচার পদ্ধতি মুখস্থ করে যাজকতা করার মনোবৃত্তি তাঁর একদম ছিল না । মায়ের পুজোর জন্য ফুল তোলেন, মালা গাঁথেন এবং বিগ্রহ সাজান এসব কাজের সময় তিনি আত্মমগ্ন থাকেন ডাকলেও তাঁর সাড়া পাওয়া যায় না।

পূজকপদ লাভ পরিবর্তন : 

অবশেষে রামকুমারের মৃত্যু হয় , রামকৃষ্ণের তখন মাত্র বাইশ বছর বয়স । রানী রাসমণি তাঁকে ভবতারিণীর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করলেন । পূজারিরূপে তাঁর জীবনে আসে এক বিরাট পরিবর্তন।তাঁর পুজোর রীতি ছিল একদমই আলাদা। তন্ত্র-মন্ত্র শাস্ত্রচার তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। পুজো করতে করতে তিনি চেয়ে থাকতেন কালীমূর্তির দিকে, চোখ দিয়ে জল পড়ত, আকুলম্বরে ডাকতেন ‘মা-মা’। সেই ছিল তাঁর পূজার অর্ঘ্য, ভজন পূজনের মহামন্ত্র । তাঁর মাতৃবন্দনার অশ্রুসিক্ত আকুলতা , পূজা অর্চনার প্রতি গভীর অনুরাগ সকলকে অভিভূত করত।তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন জগজ্জননীর মহিমময়রূপ । প্রস্তরময়ী দেবী তাঁর কাছে প্রাণময়ী জননী । হৃদয়ের সমস্ত ভক্তি অনুরাগ তিনি দেবীর চরণে উজাড় করে দিতেন।

বিবাহ : 

গভীর রাতে নির্জন পঞ্চবটী বনে গিয়ে , চিন্ময়ী মায়ের ধ্যানে মগ্ন হতেন । আবার মায়ের চরণে অশ্রসিক্ত অর্ঘ্য নিবেদন , গলা ছেড়ে কেঁদে কেঁদে বলতেন, ‘মা, এখনো তোর দেখা পেলাম না, এবার দেখা দে। এই কোঠর সাধনার ফলে তিনি  একদিন প্রত্যক্ষ করেছিলেন , চিন্ময়ী মায়ের জ্যোতির্ময়রূপ ।

গদাধরের আনুষ্ঠানিক পুজো করার ক্ষমতা ছিল না। সর্বদাই তিনি মাতৃধ্যানে মগ্ন , তাঁর কণ্ঠে সোনা যেত রামপ্রসাদী সঙ্গীত । গদাধরের এইরূপ পরিবর্তনে, ভীত  হয়ে তাঁর মা পুত্রকে কামারপুকুরে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন । সংসারের বাঁধনে তাঁকে আটকাতে চাইলেন । রামকৃষ্ণের বয়স তখন চব্বিশ জয়রামবাটীর শ্রীরামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সারদামণির সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিলেন। কিন্তু বিবাহিত স্ত্রীকেও গদাধর মাতৃজ্ঞানে পুজো করতে লাগলেন এবং কিছুদিন গ্রামে থেকে পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসেন । 

সাধনা সিদ্ধিলাভ : 

বিয়ের পর দক্ষিণেশ্বরে ফিরে এসে গদাধরের সাক্ষাৎ হয় এক ভৈরবীর সঙ্গে  যার নাম যোগেশ্বরী । গদাধরের মধ্যে মহাভাবের লক্ষণ দেখে ভৈরবী তাঁকে তন্ত্র-মতে সাধন-ভজন করতে শেখান। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবদেশীয় মহাসাধক তোতাপুরীর  বৈদান্তিক সাধনায় গদাধরকে অনুপ্রেরণা দান করেন। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে তোতাপুরীর  সময় লেগেছিল চল্লিশবছর , সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ মাত্র তিন দিনেই তা আয়ত্ত করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করলেন। তোতাপুরী গদাধরের নাম দিলেন ‘পরমহংস’ ।

পরবর্তী পর্যায়ে রামকৃষ্ণ মুসলমান ফকিরের কাছে ইসলাম মতে সাধন-ভজন করেন। যীশুভাবে খ্রিস্টান মতের ‘প্রার্থনা’ও তিনি করেছেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, সমস্ত ধর্মের মূলকথা ঈশ্বর দর্শন, পথ পৃথক হলেও গন্তব্য এক ,“যত মত তত পথ তারপর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেদিন নিজের স্ত্রীকে চিন্ময়ীরূপে উপাসনা করে নারীত্বকে বসালেন মাতৃত্বের পবিত্রাসনে, সেদিন হল তাঁর সাধনার পরিসমাপ্তি তিনি হলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ ।

রামকৃষ্ণের বাণী ও শিষ্যসম্প্রদায় :       

দিকে দিকে প্রচারিত হল রামকৃষ্ণের সাধনা সিদ্ধির সংবাদ। ধর্মসাধনায় সিদ্ধিলাভের পর রামকৃষ্ণদেবের কাছে বহু শিষ্যের আবির্ভাব হতে থাকে। নানা দেশ-দেশান্তর থেকে আসতে লাগল নানা জ্ঞানীগুণীর দল,এলেন কত সিদ্ধ মহাপুরুষ,কত পথভ্রান্ত , দগ্ধ প্রাণ তাঁর চরণতলে আশ্রয় নিলেন ।  গিরীশ, সুরেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ গৃহী ভক্তজন , দক্ষিণেশ্বরের নির্জন প্রান্তর পরিণত হল মানুষের মহামিলন ক্ষেত্রে । তাই কবিগুরু বলেছেন –

” বহু সাধকের     বহু সাধনার ধারা 

ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তাঁরা 

তোমার জীবনে অসীমের লীলা পথে

 নতুন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে । “

তবে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিল নরেন। স্বামী বিবেকানন্দ নামে যিনি  ভুবনবিখ্যাত। শ্রী শ্রী ঠাকুরের মানব-সেবার বাণী বিবেকানন্দই প্রথম সারা বিশ্বে প্রচার করেন। স্বামিজীর প্রচেষ্টায় জগতের নানা স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রামকৃষ্ণ মিশন।

পরলোক গমন : 

অবশেষে এগিয়ে এল সেই বিষাদের দিন , ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট দুরারোগ্য কর্কট রোগে শ্রী শ্রী ঠাকুর পরলোকগমন করেন । এই বাংলা তথা বিশ্ব হারাল এক মহামানব ও ধর্ম গুরুকে।

উপসংহার : 

রামকৃষ্ণ ছিলেন ঊনবিংশ শতকের বাঙালি ভক্তি সাধনার এক মূর্ত প্রতীক । তৎকালীন সমাজে  একদিকে যেমন নবাগত খ্রিষ্টধর্মের প্রবল প্লাবন , জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কর্ম চিন্তায়, ধর্মবোধে যে উন্মাদনা গোটা দেশকে মাতিয়ে তুলেছিল । অন্যদিকে ঈশ্বর বিশ্বাসে সংশয় , সন্দেহ , জাতি বিভ্রান্ত, দিশেহারা , সেই বিপর্যয়ে আলোর পথ দেখাতে এসেছিলেন পরমাত্মা শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর অমৃতবাণী , ও জীবসেবার মাহাত্ম্য কীর্তন সারা পৃথিবীতে সমাদৃত । বিশ্বের সামনে তিনি রেখে গেলেন ঈশ্বর সাধনার এক উজ্জ্বল , মহৎ দৃষ্টান্ত ।

Thanks For Reading : রামকৃষ্ণ পরমহংস

 

■ অনুসরণে লেখা যায়

একজন মহামানব

পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ 

বাংলার একজন ধর্মগুরু  

একজন পরমপুরুষের কথা


আরো পড়ুনঃ   


 

Leave a comment