লক কিভাবে সহজাত ধারণা খন্ডন করেন

পাশ্চাত্য দর্শনে  জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় জন লক নতুনভাবে অভিজ্ঞতাবাদের প্রয়োগ করেছেন। অভিজ্ঞতাবাদের প্রয়োগ করে তিনি ডেকার্টের সহজাত ধারণা খন্ডন করেন। তিনি বলেছেন –সহজাত ধারণা বলে কিছু নেই । আমরা এখানে আলোচনা করবো জন লক কিভাবে ডেকার্টের সহজাত ধারণা খন্ডন করেছেন।

লক কিভাবে সহজাত ধারণা খন্ডন করেন
লক কিভাবে সহজাত ধারণা খন্ডন করেন

 

লক কিভাবে সহজাত ধারণা খন্ডন করেন ।( Explain Locke’s objections against Innate Ideas)

সহজাত ধারণা কাকে বলে

লকের গ্রন্থের মুখ্য উদ্দেশ্য হল –  “জ্ঞানের মূল উৎস, তার যথার্থ ও সীমানা সম্পর্কে আলোচনা করা এবং সেই সঙ্গে মানুষের বিশ্বাস মতামত ও কোন ব্যাপারে তার সম্মতিরও উৎস ও মাত্রা নির্ধারন করা।” লক্‌ এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন তা হল, জ্ঞান সঞ্চয়ের এযাবত পুঞ্জিভূত যাবতীয় আবর্জনা অপসারিত করা। এই প্রসঙ্গে লক্‌ মনে করেন -জ্ঞানতত্ত্বের সূচনার পূর্বে প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ন কাজ হল সহজাত ধারণা তত্ত্বকে সমূলে চিরকালের মতো নিমূর্ল করা তাই প্রসঙ্গতই প্রশ্ন ওঠে সহজাত ধারণাতত্ত্ব বলতে কী বোঝায় ?

“Innate Ideas” বা “সহজাত ধারণা”- এই নামকরণ থেকেই বোঝা যায় যে, এই সকল ধারণা আমরা কোন বাহ্যবস্তু থেকে পাইনা বা আমরাও এদের সৃষ্টি করিনা। বরং এই ধারণা গুলি আমাদের অন্তরে নিহিত। বুদ্ধিবাদী দার্শনিকগণ অন্তর বা সহজাত ধারণার কথা বলে। তাদের মতে ঈশ্বর আমাদের জন্মের সময় এই সকল ধারণাগুলিকে আমাদের মনে গ্রথিত করে রেখেছেন।

লকের সহজাত ধারণা খন্ডন 

অভিজ্ঞতাবাদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অভিজ্ঞতাবাদী ইংরেজ দার্শনিক জন লক্‌ প্রথমেই অভিজ্ঞতা পূর্ব অন্তর ধারণা অস্তিত্ব খন্ডন করেন। লকের মতে আমাদের ধারণা সমূহের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে অণুসন্ধান করার ইচ্ছার অভাব থেকেই বুদ্ধিবাদী দার্শনিক সম্প্রদায়ের অন্তর ধারণাবাদ উদ্ভূত হয়েছে। বাস্তবিকই এই মতবাদের সমর্থনে কোন যুক্তি নেই, বরং লকের মতে অন্তরধারণা না মানার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে বস্তু লক্‌ নিম্নোক্ত কতকগুলি যুক্তি দিয়ে তথাকথিত অন্তরধারণাগুলিকে খন্ডন করেন

১.   লক্‌ বলেন মানুষের মনে যদি সত্যি কতকগুলি ধারণা নিহিত থাকত, তাহলে সকল মানুষের বিশেষত যাদের মনের উপর প্রত্যক্ষ জ্ঞানের কোন প্রভাব পড়েনি তাদের মনেও এই ধারণা গুলি থাকত এইরূপ সিদ্ধান্ত আমরা করতে পারি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায় না। শিশু, নির্বোধব্যক্তি প্রভৃতিদের মনে কার্য-কারন সম্বন্ধ সমতা, ঈশ্বর ইত্যাদির ধারণা থাকেনা।

বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা যেতে পারে যে, এই সকল অন্তর ধারণা আমাদের মনে জন্ম থেকেই থাকে, কিন্তু আমরা তাদের জানতে পারিনা। এর উত্তরে লক্‌ বলেন কোন ধারণা আমাদের মনে আছে অথচ আমাদের মন একে জানেনা এটি একেবারেই অসম্ভব। মনে কোন কিছুর ছাপ অঙ্কিত করা হয়েছে অথচ মন তা জানে না এটি একটি স্ববিরোধি উক্তি।

২. লকের মতে এমন কোন নীতি নেই যা সকলেই স্বীকার করেন। জ্ঞানের ক্ষেত্রেই হোক বা কার্যের ক্ষেত্রেই হোক এমন কোন তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় না যার সত্যতা সর্বসম্মতো । কার্যের ক্ষেত্রে যে এইরূপ কোন তত্ত্ব নেই তা বিভিন্ন যুগের জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারা যায়।  এমন কোন নৈতিক নিয়মই পাওয়া যায়না যা সকল জাতি মেনে নিয়েছে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন নৈতিক নিয়মের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

এর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় ধর্ম , অধর্ম জ্ঞান নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে না। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পারিপার্শিকের মধ্যে ধর্মাধর্মের জ্ঞান ভিন্ন ভিন্ন হয়। “অন্যের নিকট যে রূপ ব্যবহার তুমি আশা কর, অন্যের সঙ্গে সেই রূপই ব্যবহার কর।”- এই নীতির বিষয় আলোচনা করলে দেখা যায় যে, অসৎ জাতির লোকেরা এইরূপ কোন নীতির স্বীকার করে না। ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে এইরূপ যে কোন সহজাত প্রত্যয় নেই, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।

৩. এছাড়াও লক্‌ বলেন, যদি স্বীকার করে নেওয়া যায় যে এমন কতগুলি নীতি আছে যে সকলেই মানে তাহলেই যে, এদের সহজাত বলতে হবে এমন কোন কথা নেই। অন্য উপায়ে এই সকল জ্ঞান লাভ করা সম্ভব – এমনটি যদি প্রমাণ করা যায় তাহলে তাদের সহজাত বলার পক্ষে কোন যুক্তি থাকে না। বাস্তবে এমন নিয়ম বা বচন আছে যেগুলি সর্বোজন স্বীকৃত, অথচ সহজাত ধারণা নয়। “অগ্নি দহন করে” -এই বচনটি সকলেই সত্য বলে স্বীকার করে কিন্তু সেকার নেই এটিকে অভিজ্ঞতা পূর্ব বা সহজাত বলে কেউ মেনে নেবেন না।

লক্‌ সহজাত ধারনাবাদ খন্ডন করেছেন সত্য, কিন্তু এই মতবাদ কোন বিশেষ দার্শনিক বা দার্শনিক সম্প্রদায় প্রচার করেছেন সে বিষয়ে কিছু বলেননি। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হল এই যে, এই মতবাদ কতগুলি, মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। এই কথা থেকে মনে হয় ডেকার্ত বা অন্য কোন বিশেষ দার্শনিক বা দার্শনিক সম্প্রদায়ের সহজাত ধারণাবাদ খন্ডন করা লকের উদ্দেশ্য নয়, সাধারণভাবেই সহজাত ধারণাতত্ত্ব খন্ডন করাই তাঁর অভিপ্রায়।

লক্‌ যে সহজাত ধারণা খন্ডন করেন তা কিন্তু তার নতুন আবিষ্কার নয়। কেননা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সেন্ট ট্মাস অ্যাকুইনাস নামে একজন দার্শনিক সহজাত ধারণা বর্জন করেছিলেন। লকের পরবর্তীকালে লাইবনিজ অবশ্য অন্তর ধারণার অস্তিত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। লক্‌ যেখানেই অন্তর ধারণা অস্তিত্ব অস্বীকার করেন সেখানেই লাইবনিজ বলেন আমাদের সকল ধারনাই সহজাত।

লাইবনিজের মতে লকের সহজাত ধারণার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হবে যদি প্রমাণ করা যায় যে, মন সর্বদাই তার ধারণা সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু মনের এমন অনেক প্রতীতি আছে যার সম্পর্কে মন সচেতন নয়। কাজেই অবচেতন মনে অন্তর ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করা যেতেই পারে।

লক কীভাবে জ্ঞানের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেন   

জ্ঞানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লক্‌ বলেছেন- জ্ঞান হল দুটি ধারণার মধ্যে মিল ও অমিল প্রত্যক্ষ করা। জ্ঞানের বিষয় কোন একটি ধারণা নয়, ধারণার পারস্পরিক সম্বন্ধ। বিভিন্ন ধারণার মধ্যে এই প্রকার মিল ও অমিল চার রকমের হতে পারে যথা

১. অভিন্নতা ও ভিন্নতা,

২. দুটি ধারনার মধ্যে সরাসরি সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ,

৩. একই বস্তুতে কতকগুলি ধারণার সহাবস্থান এবং

৪. বাহ্যবস্তুর সাথে ধারণার অনুরূপতা থাকা বা না থাকা,

অর্থাৎ আমরা বলতে পারি এই চার রকম ভাবে দুটি ধারণার মধ্যে মিল ও অমিলের মাধ্যমেই জ্ঞানের উৎপত্তি হয়ে থাকে। জ্ঞান যদি ধারণার মধ্যে মিল অথবা অমিল প্রত্যক্ষ হয় তাহলে মানতে হয় যে সে সুদূর প্রসারী নয়, জ্ঞানের সীমানা আছে। যেখানে ধারণা সেখানে জ্ঞানও নেই,  আবার জ্ঞানের জগত ধারণার জগতে সীমাবদ্ধ হলেও তাদের ক্ষেত্রে সমব্যাপক নয়। জ্ঞানের ক্ষেত্র ধারণার ক্ষেত্র অপেক্ষা কমব্যাপক। ধারণা না থাকলে যেমন জ্ঞান উৎপত্তি হয় না, তেমনি ধারণা থাকলেই যে জ্ঞান হয় এমন নয়। আমাদের এমন অনেক ধারণা আছে যা সুষ্পষ্ট নয়। এমন অস্পষ্ট ধারণা জ্ঞানের উপাদান হতে পারে না।

জ্ঞানের উৎপত্তি আলোচনা করতে গিয়ে যেটি উল্লেখযোগ্য সেটি হল- জ্ঞানের এই প্রকার সংজ্ঞা দিয়েও লক্‌ অসঙ্গগতভাবে তিনপ্রকার অস্তিত্ব বাচক জ্ঞানের উল্লেখ করেছেন যথা-

১.  নিজের অস্তিত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব।

২. নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হল স্বজ্ঞামূলক জ্ঞান,

৩. ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হল – প্রমাণমূলক জ্ঞান এবং বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হল সংবেদন মূলক জ্ঞান।

সত্যতার নিরিখে স্বজ্ঞামূলক জ্ঞান অসন্দিগ্ধ/ নিশ্চিত সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান, প্রমাণ মূলক জ্ঞান সুনিশ্চিত হলেও তা স্বজ্ঞামূলক জ্ঞান নির্ভর বলে পরোক্ষ জ্ঞান। সংবেদন মূলক জ্ঞান সঠিক অর্থে জ্ঞান পদবাচ্য নয়। কেননা তা কখনও সুনিশ্চিত হতে পারে না।


প্রশ্ন-উত্তর:

1. সকল ধারণাই সহজাত কে এবং কেন বলেছেন?

উত্তর-  সকল ধারণাই সহজাত বলেছেন ডেকার্ট।

2.  সহজাত ধারণার উদাহরণ।

উত্তর-  সহজাত ধারণার উদাহরণ হল  ঈশ্বরের ধারণা, কার্যকারণ তত্বের ধারণা, চিন্তার  সূত্র ইত্যাদি।

৩. সহজাত ধারণা বলতে কি বুঝ ?

উত্তর-  যে সকল ধারণা আমরা কোন বাহ্যবস্তু থেকে পাইনা বা আমরাও এদের সৃষ্টি করিনা। বরং এই ধারণা গুলি আমাদের অন্তরে নিহিত।

 


আরো পড়ুন –

লক কিভাবে মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন

আকার ও উপাদান সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য

অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব

জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো

চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?

ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ


 

Leave a comment