লক কিভাবে মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন

পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে জন লক একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে জন লক মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন । 

লক কিভাবে মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন
লক কিভাবে মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন

 

কীভাবে লক্‌ মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেন। এই মত কী গ্রহণযোগ্য।

  লক্‌ মুখ্য গুণ ও গৌন গুণের মধ্যে পার্থক্য করেন। বলা প্রয়োজন যে, লক্‌ ছাড়াও গ্যালেলিও , ডেকার্ত, স্পিনোজা, হবস্‌ প্রভৃতি দার্শনিকরাও গুণের এই শ্রেণীবিভাগ স্বীকার করে নেন। যাই হোক লকের মতে, মুখ্যগুন গুলি বস্তুগত, অর্থাৎ তারা বস্তুতেই অবস্থান করে।

অপরদিকে, গৌনগুণ গুলির আসলে কোন অস্তিত্ব নেই, এগুলি বস্তু নিরপেক্ষ ও ব্যক্তি জ্ঞানের উপর নির্ভর। রূপ রস, বর্ন, গন্ধ প্রভৃতি এই জাতীয় গুণ। মুখ্য গুণগুলি হল আকার, আয়তন, বিস্তার ও গতি। এই মুখ্যগুনগুলি বস্তুর স্বতঃ পরিবর্তনেও  শাশ্বত অপরিবর্তিত থাকে। মুখ্য ও গৌন গুণের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিম্নোক্ত কতকগুলি যুক্তি দিয়েছেন –

(i) গৌণগুণ গুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন রকম। যেমন , কোন একটি জিনিসের আশ্বাদ ব্যক্তিভেদে এক একজনের এক একরকম হতে পারে। যা একজনের কাছে মিষ্টি, তা আর একজনের কাছে তা নাও হতে পারে। এইজন্য লক্‌ মনে করেন, এইগুণগুলি বস্তুগত নয়, ব্যক্তিগত। কিন্তু বস্তুর বিস্তার , আকার , আয়তন প্রভৃতি সকলের কাছে একইরকম মনে হয়। কাজেই এগুলি বস্তুগত।

(ii) গৌণগুণগুলি পরিবর্তনশীল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। মুখ্যগুণগুলি দ্রব্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে। অর্থাৎ দ্রব্যের অবস্থা যাই হোক না কেন মুখ্যগুণগুলি সকল অবস্থাতেই দ্রব্যে বর্তমান থাকে। যেমন – একটি সরষেরর কনাকে যদি দুটি অংশে বিভক্ত করা হয় তাহেল দেখা যাবে যে, তার প্রতিটি অংশেরই কঠিন্য, ব্যাপ্তি, আকৃতি প্রভৃতি ধর্ম উপস্থিত রয়েছে। তাকে যদি আরো ক্ষুদ্রতর অংশে বিভক্ত করা যায় তাহেলও দেখা যাবে যে বিভক্ত অংশগুলিতে পূর্বোক্ত গুণগুলি বিদ্যমান। কিন্তু সোনাকে যদি গলানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে শেষ পর্যন্ত পূর্বের বর্ন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

মুখ্য ও গৌনগুনগুলির মধ্যে পার্থক্য প্রতিপাদনের জন্য লক্‌ যেসব যুক্তি দিয়েছেন সেগুলি কিন্তু গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। যে যুক্তিগুলির সাহায্যে তিনি গৌণগুণগুলির ব্যক্তি সাপেক্ষতা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন ঠিক সেগুলি দিয়েই মখ্যুগুনগুলি ব্যাপ্তি সাপেক্ষতা প্রমাণ করা যেতে পারে। এই দাবি লকের পরবর্তী অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক বার্কলে করেছেন।

এখন দেখা যাক,  কীভাবে বার্কলে মুখ্য ও গৌন গুণের অভিন্নতা প্রতিপাদন করেন।

১. অবিচ্ছন্নতা 

বার্কলের মতে মুখ্য ও গৌনগুণের অবিচ্ছন্নতা তাদের অভিন্নতা প্রমাণ করে। উদাহরণ স্বরূপ যদি কোন বস্তুতে বর্ন না থাকে তাহলে তার আকারের পৃথক স্মৃতি অকল্পনীয়। কোন একটি যদি মুখ্য গুণ হয় তাহলে অপরটিকেও মুখ্য বলতে হয়। আবার যদি বর্ণকে মুখ্য গুণ বলতে বাধে তাহলে আকারকেও মুখ্যগুণ বলা যাবে না।

২. পরিবর্তনশীলতা 

একথা সত্য যে পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি বস্তুর বর্ন পৃথক পৃথক হয়, কিন্তু পরিবর্তনশীলতা বিষয়ী সাপেক্ষতা প্রমাণ করে তাহলে এই যুক্তি শুধুমাত্র গৌন গুণের ক্ষেত্রেই নয় আকার, আয়তন, আদি তথা কথিত মুখ্যগুণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। যেমন একটি বস্তু সামনে থেকে বড়, কিন্তু দূর থেকে ছোট দেখায় । আবার একই বস্তু কারো কাছে ভারি, কার ও কাছে হালকা মনে হয়।

৩.  সাদৃশ্য

লক্‌ বলেন আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে যা পাই তা হল মুখ্য গুণের ধারণা এবং এই ধারনাগুলির সঙ্গে বস্তুধর্মের সাদৃশ্য রয়েছে অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভবে যেসব মুখ্যগুনের ধারণা আমরা পাই তার অনুরূপ ধর্ম বাস্তব জগতের বস্তুর মধ্যে প্রকৃতই বিদ্যমান।

কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত গৌণগুণের ধারণায় অনুরূপ গুণ বস্তুর মধ্যে আছে ও নেই, বস্তুর মধ্যে আছে কেবল এইসব গুণ উৎপাদনকারী কতকগুলি শক্তি। এখানে প্রশ্ন হল- আমাদের মুখ্যগুণের ধারণাগুলি যে মুখ্য গুণের অনুরূপ তা আমরা জানব কীভাবে? দুটি বিষয়ের মধ্যে সাদৃশ্য ও প্রত্যক্ষ করতে হলে দুটি বিষয়কেই একসাথে আমাদের জ্ঞানে ধরা দিতে হয়। কিন্তু এখানে আমাদের মুখ্যগুণকে জানার সুযোগ এখানে নেই। সুতরাং মুখ্য গুণের ধারণার অনুরূপ গুণ প্রকৃতই বস্তুতে বর্তমান একথা বলা যায় না।

এইভাবে, সবগুণই গৌন। অর্থাৎ লক্‌ মুখ্য ও গৌন গুণের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপাদনের জন্য যেসব যুক্তি উপস্থিত করেছেন সেগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। যুক্তিগুলি গ্রহণযোগ্য না হলে আমরা একথা বলতে পারিনা যে, মুখ্য ও গৌন গুণের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান।

    পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লক্‌ অবশ্য গৌন গুণ গুলিকে সম্পূর্ন ব্যক্তি সাপেক্ষ বলে মনে করেননি। একথা সত্য যে, গৌণগুণ গুলি ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু তার জন্যই এই এই সিদ্ধান্ত করা সমীচিন নয় যে, গৌন গুণ গুলি আমাদের ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি। এগুলি বস্তুগত নয় সত্য, এদের বাস্তব ভিত্তি আছে, বস্তুর মধ্যে এমন একটি শক্তি আছে যা আমাদের ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করতে পারে এবং যার ফলে নান গুণের সংবেদন হয়। তবে বাহ্যবস্তুর এই শক্তি থাকলেই যে ইন্দ্রিয় উদ্দীপিত হবে এমন কোন কথা নেই। যেমন – অন্ধকারে আমরা বর্ন প্রত্যক্ষ করতে পরিনা এক্ষেত্রে বাহ্যবস্তু তার শক্তির সাহায্যে আমাদের ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করতে পারে না।

Thanks For Reading: লক কিভাবে মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন।


১. মুখ্য ও গৌণ এর মধ্যে পার্থক্য কী?

উত্তর-  গৌণগুণ গুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন রকম।কিন্তু বস্তুর বিস্তার , আকার , আয়তন প্রভৃতি সকলের কাছে একইরকম মনে হয়  কাজেই এগুলি বস্তুগত।

২.লকের মতে প্রাথমিক ও গৌণ গুণাবলীর মধ্যে সম্পর্ক কি?

উত্তর- গৌণগুণগুলি পরিবর্তনশীল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। মুখ্যগুণগুলি দ্রব্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে।

৩. লকের মতে গৌণ গুণাবলী কি কি?

উত্তর- লকের মতে গৌণ গুণাবলীগুলি হল রূপ রস, বর্ন, গন্ধ প্রভৃতি এই জাতীয় গুণ।


আরো পড়ুন –

আকার ও উপাদান সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য

অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব

জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো

চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?

ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ


 

Leave a comment