জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কান্টের বিচারবাদ

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রচলিত মতবাদ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি মতবাদ হল জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল  কান্টের বিচারবাদ । এই পর্বে আমরা পাশ্চাত্য দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো । প্রশ্নটি হল – জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কান্টের বিচারবাদ আলোচনা করো(Discuss Kant’s criticism Theory about the source of knowledge)

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কান্টের বিচারবাদ আলোচনা করো
জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কান্টের বিচারবাদ আলোচনা করো

 

বিচারবাদ  বলতে কী বোঝ?  জ্ঞান উৎপত্তি সম্পর্কে কান্টের বিচারবাদ ব্যাখ্যা করো। এই মতবাদটা কী গ্রহণযোগ্য যুক্তি দাও।

বিচারবাদ  কী ?     

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রচলিত ২টি মতবাদ হল – i. অভিজ্ঞতাবাদ ও ii. বুদ্ধিবাদ। অভিজ্ঞতাবাদ অনুসারে জ্ঞান আসে সংবেদন ও অন্ত দর্শনের মাধ্যমে। আর বুদ্ধিবাদীদের মতে, জ্ঞান আসে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমে। কিন্তু এই ২টি মতবাদই চরম ও নির্বিচারী। কান্ট মনে করেন কেবল অভিজ্ঞতা ও কেবল বুদ্ধি দিয়ে জ্ঞান লাভ করা যায় না। তিনি অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিবাদীদের মতের মধ্যে সম্বন্ধয় সাধন করে যে স্বতন্ত্র মতবাদ প্রবর্তন করেন তা ‘বিচারবাদ’ নামে পরিচিত।

 অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির সমন্বয়

কান্টের কাছে বিশুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা যে দার্শনিক জ্ঞান হয় অর্থাৎ বিশুদ্ধ পূর্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান হয় সেই জ্ঞানের সুবিন্যস্ত উপস্থাপনকে বিচারবাদী দর্শন বলা হয়। বিশুদ্ধ বুদ্ধির সামর্থ ও সীমানা  এবং অভিজ্ঞতার সামর্থ ও সীমানা বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক জ্ঞানের সম্ভাব্যতা ও সীমানা সম্পর্কে কান্ট বিচারবাদকে প্রতিষ্ঠা করেন। ‘Critique of pure reason’ নামক গ্রন্থে কান্ট বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার বিশ্লেষনের মাধ্যমে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সম্বন্বয় সাধনের চেষ্টা করে।

কান্টের বিচারবাদ অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির সমন্বয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কান্ট যথার্থ জ্ঞান বলতে তাকেই বুঝিয়েছেন যার মধ্যে অভিনবত্ব (newness) ও সর্বজোন গ্রাহ্যতা থাকবে (universality)। বলা বাহুল্য এইরূপ জ্ঞানকেই কান্ট পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেষক বলেছেন। কান্ট তার ‘Critique of pure reason’ এর গ্রন্থে বলেছেন পূর্বতসিদ্ধ সংশ্লেষক বাক্য সম্ভব এবং বাস্তব জগত সংক্রান্ত বহুউক্তি পূর্বতসিদ্ধ এবং সংশ্লেষক।

  জ্ঞানের উৎস 

কান্টের মতে, জ্ঞানের উৎপত্তি ক্ষেত্রে জ্ঞানের এক অংশ অভিজ্ঞতা নির্ভর এবং এক অংশ অভিজ্ঞতা পূর্ব। কান্টের মতে,জগতের অন্যান্য বস্তুর মতো জ্ঞানের দুটি দিক আছে একটি তাঁর আকার (forms), যা বুদ্ধির কাছ থেকে পাওয়া যায়। আর একটি হল উপাদান (material) যা অভিজ্ঞতা বা সংবেদন এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। কান্ট মনে করেন সংবেদন এর দ্বারা যে বিষয়কে পাওয়া যায় তার স্বরূপ বোধশক্তি বা বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারন করা যায়।

বস্তুর যেমন দুটি দিক আছে আকার ও উপাদান তেমনি জ্ঞানের ও আকার ও উপাদান আছে। ইন্দ্রিয় অনুভব থেকে আমরা যা পাই তা হল জ্ঞানের উপাদান। আর জ্ঞানের আকার বলতে কান্ট সেইসব ধারণাকে বুঝিয়েছেন যাদের ছাড়া বস্তুজ্ঞান সম্ভব নয়। অন্যভাবে বলা যায়, জ্ঞানের আকার এমন একটি শৈলি বা ছাঁচ যা না থাকলে আমাদের মন সংবেদনরাশির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেনা।

কান্টের মতে, জ্ঞানের আকার ২ প্রকার- একটি হল প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকার (forms of perception or sensibility) এবং অপরটি হল বোধজাত আকার (Categories of the understanding)। কোন কিছু প্রত্যক্ষ বা অনুভব করতে গেলে আমাদের সেটি দেশ ও কালের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে হয় অর্থাৎ দেশ ও কালের ধারণার সাহায্য না নিয়ে আমারা কোন সংবেদনের অর্থ বুঝতে পারিনা। তাই দেশ ও কালকে বলা হয় প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকার। বাইরের জগত থেকে পাওয়া সংবেদনরাশি যখন দেশগত ও কালগত আকার নিয়ে আমাদের মনের কাছে উপস্থিত হয় তখন মন তার ওপর দ্রব্য গুণ, কার্য-কারণ সম্বন্ধ এক বহু ইত্যাদি বোধজাত আকার আরোপ করে এবং তাদের সাহায্যে সংবেদনরাশি সুসংবদ্ধ হয়ে জ্ঞানে পরিণত হয়। অর্থাৎ অনুভবে আমরা যা পাই তা বুদ্ধির সাহায্যে বিশিষ্ট প্রকারে সম্বন্ধযুক্ত হলেই তবেই তা জ্ঞান হয়। সুতরাং জ্ঞান উৎপত্তিতে জ্ঞানের উপাদান আসে অভিজ্ঞতা থেকে এবং জ্ঞানের আকার আসে বুদ্ধি থেকে। তাই কান্ট বলেছেন- “Intuitions witout concepts are blind and concepts witout intuitons  are empty “.

প্রকৃত জ্ঞান

জ্ঞান উৎপত্তি ক্ষেত্রে কান্ট ইন্দ্রিয়ানুভূতি (sensibility) ও বোধশক্তি (understanding) ছাড়া মনের আর একটি বৃত্তি স্বীকার করেছেন বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা (reason)। ইন্দ্রিয়ানুভূতির দ্বারা দেশ ও কালে বিন্যস্ত সংবেদনসমূহ বোধের আকারে আকরিত হওয়ার পর বুদ্ধি তাদের পরস্পর সংবদ্ধ করে। ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও বোধের দ্বারা সংবদ্ধ জ্ঞানকে বুদ্ধি তার নিজস্ব ৩টি উচ্চতম ধারণার সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত করে। এই ৩টি উচ্চতম ধারণা হল – সুসংহত জগত (world), শাশ্বত আত্মা (soul) এবং জগতের আশ্রয় ঈশ্বর (god)। কান্টের মতে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা প্রদত্ত জগৎ আত্মা ও ঈশ্বর এই ৩টি নীতির সাহায্যে অভিজ্ঞতা লব্ধ ঘটনাগুলি জ্ঞানে পরিণত হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কান্টের মতে, প্রকৃত জ্ঞান হল ইন্দ্রিয়ানুভূতি, বোধশক্তি ও বুদ্ধির সম্মিলিত ফল।

সমালোচনা

কান্ট তাঁর বিচারবাদে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয় সাধন করলেও এই মতবাদ দোষমুক্ত নয়।

প্রথমত,কান্ট জ্ঞানের দুটি উপকরণ স্বীকার করেছেন – আকার ও উপাদান। কিন্তু আকার ও উপাদান এক জাতীয় নয়। উপাদান আসে সংবেদন বা ইন্দ্রিয় উপাত্তের মাধ্যমে  যা বাইরের বস্তুতে থেকে। আর বস্তু জ্ঞানের জন্য অভিজ্ঞতার সাহায্যে পাওয়া উপকরনের সংশ্লেষণ প্রয়োজন এবং এই সংশ্লেষণ বুদ্ধির দ্বারাই হয়ে থাকে। কিন্ত বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ানুভব থেকে পৃথক। তাই বুদ্ধি থেকে স্বতন্ত্র কোন কিছুকে বুদ্ধি কীভাবে সংযুক্ত করবে তা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট নয়।

দ্বিতীয়ত, বস্তু সত্ত্বার দিক থেকেও কান্টের মতবাদ সমালোচিত হয়েছে। কান্ট মনে করেন, আমাদের বস্তুর জ্ঞান অবভাসিক জগতের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু যেহেতু আমরা লৌকিক সত্ত্বার সীমা অতিক্রম করতে পারিনা তাই সীমার বাইরে কি আছে তাও আমরা জানতে পারিনা।

তৃতীয়ত, কান্টের মতে,বস্তুই আমাদের সবরকম সংবেদনের উৎস। এই সংবেদন আসে বাইরের জগতের বস্তুস্বরূপ থেকে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুর অতীন্দ্রিয় সত্ত্বা থেকে। এই সত্ত্বাই আমাদের অতীন্দ্রিয় আত্মায় সংবেদন সৃষ্টি করে থাকে। এই সংবেদনে বুদ্ধিজাত আকার যেমন দ্রব্যত্ব, বহুত্ব, একত্ব প্রভৃতি প্রত্যয় প্রয়োগ করে এগুলোকে সংবদ্ধ করে জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি করে। কিন্তু কান্টের মতে, কার্যকারন সম্পর্ক, একত্ব এগুলো আসলে বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে না। অথচ কান্ট বলেছেন, স্বরূপতঃ বস্তুই আমাদের সংবেদনের কারণ।

Thanks For Reading : জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কান্টের বিচারবাদ


আরো পড়ুন –

অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব

আকার ও উপাদান সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য

বৌদ্ধ দর্শনের অষ্টাঙ্গিক মার্গ বর্ণনা 

জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো

চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?

ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ

গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দলন


 

Leave a comment