পরিবেশ নীতিবিদ্যা দর্শনশাস্ত্রের নীতিবিদ্যা একটি অন্যতম শাখা। বর্তমানে Man And Nature হল দর্শনশাস্ত্রের SEC Paper ( Skill Enhancement Course) এর অন্তর্গত। প্রিয় শিক্ষার্থীদের SEC Paper এর উপর পাঠ গ্রহণ করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সন্মুখীন হতে হছে , সেই কথা মাথায় রেখে সম্পূর্ন বাংলায় Man And Nature থেকে প্রতিটা অংশ অলোচনা করা হল। আজকের আলোচনায় পরিবেশ নীতিবিদ্যা থেকে বৈদিক যুগের পরিবেশ চেতনা আলোচনা করো।
পরিবেশ সম্পর্কে উপনিষদ বা বৈদিক দৃষ্টিভঙ্গি | The Upanishad or Vedic view of the environment |
বৈদিক যুগের পরিবেশ চেতনা আলোচনা করো
পরিবেশনীতি বিদ্যার উদ্দেশ্য হল পরিবেশের সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র স্থাপন করা । পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা অভিনব হলেও ভারতবর্ষে পরিবেশ ভাবনার উদ্ভব হয়েছে সুদূর বৈদিক যুগ থেকে । পরিবেশ যখন অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হয়েছেন তখন থেকে পাশ্চাত্য চিন্তাধারার পরিবেশ সচেতনতা দেখা দেয় ।
কিন্তু ভারতবর্ষের ঋকবৈদিক যুগ থেকে মুনি ঋষিরা পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন । বলা বাহুল্য যে পাশ্চাত্যে পরিবেশবিদ্যার উদ্ভব হয়েছে পরিবেশ যখন দূষণের কবলে পড়ছে তখন থেকে পরিবেশ রক্ষার তাগিদ দেখা যায় । কিন্তু ভারতে পরিবেশ চিন্তার উদ্ভব হয়েছে পরিবেশের সাথে আত্মিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ।
প্রাচীন বৈদিক যুগে মুনী-ঋষিরা এবং তার শিষ্যা বা অনুগামীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলি নিন্মে আলোচনা করা হল-
(i) পরমসত্ত্বা রূপে প্রকৃতিঃ
ভারতবর্ষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শন আলোচনা অগ্রাধিকার লাভ করেছিল, সুদূর প্রাচীন কাল থেকে, প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে-আমরা প্রত্যেকেই পরমসত্ত্বার অংশ । আমাদের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই । আমরা যেমন পরমসত্ত্বার অংশ ঠিক তেমনই পরিবেশ ও পরম সত্ত্বার অংশ । তাই পরিবেশের সাথে আমাদের কোন পার্থক্য নেই । এই বিচারে বলা যায় যে , আমাদের যেমন স্বতঃ মূল্য আছে তেমনই পরিবেশের স্বতঃমূল্য আছে ।
তাই নিজেকে যেমন জানা দরকার তেমনি প্রকৃতিকে এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে জানা খুবই দরকার্ । পরমসত্ত্বার অংশ রুপে আমরা যেমন আমাদের অস্তিত্বকে মূল্যবান বলে মনে করি এবং রক্ষা করার চেষ্টা করি , ঠিক তেমনই পরিবেশ ও পরমসত্ত্বার অংশ রুপে মূল্যবান । সুতরাং প্রাচীন ভারতবর্ষের পরিবেশকে পরমসত্ত্বার অংশরূপে দেখা হতো ।
(ii) স্বতঃমুল্য রূপে প্রকৃতিঃ
প্রকৃতির প্রতি সমাজের নৈতিক দায়বদ্ধতা আছে কারন প্রকৃতির নিজস্ব বা স্বতঃমূল্য আছে । প্রাচীন ভারতবর্ষের পরিবেশের সমস্ত কিছুকে স্বতঃমূল্য হিসাবে দেখা হত। ঋক সংহিতায় বলা হয়েছে , জগৎ মধুময়, বাতাস মধুবহন করে , সমুদ্র মধু রক্ষা করে , রাত্রি মধু ভোগ করে , পৃথিবীর ধূলিকণা মধুর হোক , সূর্য মধুময় হোক । এই মধুময় আনন্দের প্রকাশ মানুষের প্রকাশ মানুষের জীবন ও সমগ্র জগতে তার প্রতিফলন ঘটেছে ।
ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল কথায় হল সর্বভূতে সমান দৃষ্টিভঙ্গি। এক্ষেত্রে পরিবেশবাদ যাইনি । প্রাচীন ভারতবর্ষের পরিবেশকে সাম্গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়েছে । যেহেতু পরিবেশের ও স্বতঃমূল্য রয়েছে ।
(iii) ঋষি ঋণ – পরিশোধ ও প্রকৃতিঃ
শ্রুতিতে বলা হয়েছে মানুষ জন্ম সূত্রে তিন ঋণে আবদ্ধ , যথা – দেব ঋণ , পিতৃ ঋণ , ও ঋষি ঋণ হল পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের প্রতি ঋণ পরিশোধ । মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বায়ু , আলো , মৃত্তিকা , ও উদ্ভিদ জগতের উপর নির্ভর করতে হয় , তাই আমরা এদের কাছে ঋণী । প্রকৃতির উপাদানগুলিকে সংরক্ষণ ও স্বতঃ মূল্য দেওয়ার মাধ্যমে ঋষিঋন পরিশোধ করতে হয় । তাই ভারতীয় চিন্তাধারার বৈদিক যুগ থেকে ঋনের ধারণার মাধ্যমে পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংরক্ষণের নীতি প্রচলিত ।
(iv) আত্মিক সম্পর্ক রূপে প্রকৃতিঃ
বৈদিক সাহিত্যে পরিবেশের প্রতি মানুষের আত্মিক সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায় । “বসুবৈধ কুটুম্বকম ”- এই সূত্রে বিশ্ব জগতকে এক বৃহৎ পরিবার রূপে দেখানো হয়েছে । ঋকবেদের সময়কালে পরিবেশের কোনোরকম অবক্ষয় ছিল না । মানুষ প্রকৃতির উপর দেবও শক্তি আরোপ করে প্রকৃতিকে অতীব পবিত্র বলে মনে করত ।
তাই তারা কখনো প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করত না । বৈদিক যুগের এইরূপ পরিবেশ ভাবনা শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণের চিন্তায় আবদ্ধ ছিল না । এ প্রসঙ্গে শ্রুতিতে বলা হয়েছে “ সর্বজীব যেন দুঃখ থেকে নিরাময় লাভ করে , কস্মিনকালেও কেউ যেন দুঃখ ভোগ না করে , ভারতবর্ষের প্রাচীন পরিবেশ ভাবনাই পরিবেশের প্রতি এমন উদার মানসিকতা আত্মিক সম্পর্কের ঈঙ্গিত বহন করে ।
অর্থববেদে পৃথিবী সুক্তে ধরিত্রী মাতাকে বন্দনা করা হয়েছে । এই সুক্তে বলা হয়েছে “মাতা ভুমিঃ পুত্রহম পৃথিব্যারঃ ” অর্থাৎ ধরিত্রীকে মাতারূপে এবং মনুষ্য নিজেকে তার পুত্ররূপে গণ্য করেছেন । এই সুক্তের গভীর অর্থ অনুযায়ী পৃথিবীপৃষ্ঠ মাতার মতো হবে । তাই প্রাচীন মুনি ঋষির ভূপৃষ্ঠের ওপর কৃষিকাজ হেতু যে কষ্ঠ মাতার অনুভব তারা নিজেরাও করেছিলেন ।
তাই ধরিত্রী যুগের আধিপত্য বিস্তারের কোন প্রসঙ্গই বৈদিক যুগে ছিল না । এই কারনে ঋষিগণ ধরিত্রী মাতার কাছে সকরুণ পার্থনা করতেন , যেন ধরিত্রী মাতা হৃদয় ব্যাথিত না হয় । তাছাড়া পৃথিবী সুক্তে আরও বলা হয়েছে যে ধরিত্রী মাতার সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের আত্মিক সম্পর্ক আছে। মাতার সাথে তার সন্তানের যে সম্পর্ক তা অভিন্ন ,তাই পৃথিবী সুক্তে পার্থনা মন্ত্রে বলা হয়েছে – “ যৎ তে ভুমেঃ বিক্ষাণি ক্ষিপ্রঃ তদপি রোহতু ” ।
অর্থাৎ তোমার ভূমিতে যে বৃক্ষটি ক্রর্তন করা হল সেখানেই ক্ষিপ্রতার সাথেই বৃক্ষ পুনঃপ্রতিষ্ঠান করা উচিত। বর্তমান পরিবেশ নীতিবিদ্যায় পরিবেশ নীতিবিজ্ঞাগণীরা বাস্ততন্ত্রের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বারবার মানুষকে সচেতন করেছেন। Eco-friendly বা পরিপূরক সহাবস্থান এই আধুনিক চিন্তাভাবনার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে বৈদিক মুনীঋষিরা এই Eco-friendly পরিবেশ চিন্তা করেছিলেন ।
প্রাচীন ভারতে বৃক্ষ বনভূমি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল । পৃথিবীর সাথে ধর্মীয় আবেগকে যুক্ত করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ভাবা হয়েছে বট, অশ্বত্থ, নিম , চন্দন ইত্যাদি বৃক্ষগুলি দেব দেবী। অনেক উপজাতির সম্প্রদায়ের এমন চিন্তাধারা আছে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা বৃক্ষে অবস্থান করেন।
বটবৃক্ষে ব্রহ্মা বাস করেন, অশ্বথ বৃক্ষে ভগবান বিষ্ণু বাস করে, নিমগাছে শীতলাদেবী বাস করে । এই ভাবে তরুলতা বৃক্ষাদিদের পবিত্ররূপে বর্ণনা করেছেন । ভারতবর্ষের নদ-নদী পাহাড় -পর্বত ইত্যাদি সকল কিছুকেই দেবতার আসনে বসানো হয়েছে , তাই দেবতাদের অবক্ষয় ভারতীয় নীতিবিদ্যা সম্মত নয় ।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় – “যাকে বিনামূল্যে পেয়েছো তাকে সচেতন ও সাধনার মূল্যে লাভ করো, যে অজস্র অক্ষয় সম্পদ বাহিরে রয়েছে তাকে অন্তরে গ্রহণ করে ধন্য হও।”
Thanks For Reading –বৈদিক যুগের পরিবেশ চেতনা আলোচনা করো।
আরো পড়ুন
- পরিবেশ সংরক্ষণে স্বতঃ মূল্যের গুরুত্ব লেখ
- স্বতঃমূল্য সম্পর্কে G.E MOORE-এর তত্ত্ব
- পরিবেশ নীতিবিদ্যা | স্বতঃমূল্য ও পরতমূল্যে
- অধিবিদ্যা কী | অধিবিদ্যার প্রকৃতি আলোচনা করো
- আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো
- ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ