পাশ্চাত্য দর্শন প্রধানত তিনটি শাখায় বিভিক্ত যথা- ১. অধিবিদ্যা ২. জ্ঞানবিদ্যা ও ৩. নন্দনবিদ্যা। দর্শন আলোচনার এই পর্বের বিষয় হল- অধিবিদ্যার সম্ভাব্যতা বিষয়ে দার্শনিক হিউম ও কান্টের মতবাদ ।
অধিবিদ্যার সম্ভাব্যতা বিষয়ে দার্শনিক হিউম ও কান্টের মতবাদ |
অধিবিদ্যা অসম্ভব এই বিষয়ে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউম এবং বিচারবাদী দার্শনিক কান্টের মতবাদ আলোচনা করা হল ।
হিউমের মতবাদঃ
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউমের মতে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই জ্ঞান লাভের একমাত্র উৎস। হিউমের মতে জ্ঞান হল ধারণার অণুসঙ্গ এবং ধারণার ভিত্তি হল মুদ্রন বা ইন্দ্রিয় সংবেদন। কাজেই আমাদের জ্ঞান মুদ্রণ বা সংবেদনের সীমানাকে অতিক্রম করতে পারে না। জ্ঞানের অন্তঃগর্ত কোনো ধারণা সম্পর্কে সংশয় দেখা দিলে আমাদের দেখতে হবে সেই ধারণার পিছনে কোনো মুদ্রণ বা সংবেদন আছে কিনা।
ধারণাটি মুদ্রণ ভিত্তিক হলে তাকে গ্রহণ করা যাবে, আর মুদ্রণ ভিত্তিক না হলে তা গ্রহণ করা যাবে না। এই যুক্তির মাধ্যমে হিউম অধিবিদ্যাকে বাতিল করেছেন। কারণ, ঈশ্বর, আত্মা, দ্রব্য, কার্যকারণ ইত্যাদি অধিবিদ্যক ধারণা সম্পর্কে আমাদের কোনো ইন্দ্রিয়ের সংবেদন বা মুদ্রণ হয় না। তাই এগুলির অস্তিত্ব নেই।
হিউম ‘Enquiry’ গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে তিনি মুক্তি হীন অধিবিদ্যার সমালোচনা করলেও , যুক্তিযুক্ত অধিবিদ্যার বিরোধিতা করেননি। কারণ, তার মতে যুক্তিযুক্ত অধিবিদ্যা মানবজীবনে বিশেষভাবে মূল্যবান। এবং তা সমুদ্রায়ন বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক হতে পারে। হিউমের অনেক ভাষ্যকারও পরবর্তীকালে এইরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
কান্টের মতবাদঃ
জার্মান দার্শনিক কান্ট অধিবিদ্যার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কান্ট তার জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির যুগ্ম প্রক্রিয়ায় আমরা কেবল বস্তুর অবভাসকেই জানতে পারি। সত্ত্বা বা বস্তু সরূপ আমাদের জ্ঞানগম্য নয়। পরিদৃশ্যমান জগতের মূলে যে বস্তুস্বরূপের জগৎ, তাকে স্বরূপে এবং অবিকৃতরূপে জানা আমাদের সাধ্যায়ত্ত্ব নয়।
স্বয়ং সদবস্তুকে স্বরূপ জানতে হলে তার থেকে সৃষ্ট সংবেদন রাশিকে আবিকৃত রূপে জানতে হয়। কিন্তু আমাদের মনের গঠনই এমন যে ইন্দ্রিয় পথ দিয়ে যেসব উপান্ত (Sense -data) আমাদের মনে উপস্থিত হয়, তা আমাদের মনের আকার (forms) ও প্রকারে (categories) আকারিত হয় এবং তবে আমরা তাদের জানতে পারি।
অর্থাৎ আমাদের মনের আকার ও প্রকার প্রয়োগ করে আমরা বাহ্য জগৎকে জানি, যে জগৎ আমাদের মনেরই রচনা মাত্র। অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানের জগৎ স্বয়ং-সদ্স্তুর অবভাস মাত্র। এজন্য কান্ট বলেছেন, সত্য বা সত্ত্বা অস্তিত্বশীল হলেও তা মানব মনের কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়।
কান্ট তাঁর জ্ঞানতত্ত্বে বস্তুসত্ত্বাকে (Reality) অজ্ঞাত বললেও, তিনি একথা স্বীকার করেছেন যে, তত্ত্ব আলোচনা বিচারশীল মানুষের জীবনে এক অনিবার্য ও আবশ্যিক প্রয়াস। কান্ট নিজেও তত্ত্ব আলোচনা থেকে বিরত থাকতে পারেননি। মানব মনের আকার ও প্রকারের স্বরূপ উদঘটনে কান্ট যেসব জ্ঞান তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন তা আসলে তত্ত্বেরই আলোচনা।
কাজেই, অধিবিদ্যাকে অসম্ভব বলা যায় না। পরন্ত এই কথাই বলতে হয় যে ,”To say that metaphysics is nonsense, is nonsense”.
সুতরাং , দর্শন ও অধিবিদ্যা সম্পূর্ন এক নয়, আবার সম্পূর্ন পৃথকও নয়। বস্তুত দর্শন ও অধিবিদ্যার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। অধিবিদ্যা দর্শনের একটি অপরিহার্য শাখা। অধিবিদ্যার মূল লক্ষ্য হল তত্ত্ব বা সত্তাকে জানা।
অধিবিদ্যাকে দর্শনের আর একটি শাখা জ্ঞানবিদ্যা উপর নির্ভর করতে হয়। জ্ঞানবিদ্যা জ্ঞানের উৎপত্তি, সম্ভাবনা , শর্ত, সীমা, বৈধতা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। তত্ত্বজ্ঞাম সম্ভব কি না, এ কথা জানার জন্য অধিবিদ্যাকে জ্ঞানবিদ্যার উপর নির্ভর করতে হয়। বস্তুত, জ্ঞানবিদ্যার বিচারবিশ্লেষণের সাহায্যে দর্শন অধিবিদ্যাকে নির্বিচার ও অন্ধবিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করে।
অপরপক্ষে দর্শনকেও অধিবিদ্যার উপর নির্ভর করতে হয়। দর্শন জগৎ ও জীবনের স্বরূপ নির্ণয় করার চেষ্টা করে। এজন্য দর্শনকে অধিবিদ্যা সাহায্যে নিতে হয়। কারণ, অধিবিদ্যার বিষয়বস্তু তত্ত্বের আলোকেই দর্শন জগৎ ও জীবনের প্রকৃত স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে পারে।
Thanks For Reading: অধিবিদ্যার সম্ভাব্যতা বিষয়ে দার্শনিক হিউম ও কান্টের মতবাদ ।
আরো পড়ুন
- আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি উক্তিটি ব্যাখ্যা করো
- অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব
- জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো
- চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?
- ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ
- প্রশ্ন উত্তরে চার্বাক দর্শন
- পরিবেশ সংরক্ষণে স্বতঃ মূল্যের গুরুত্ব লেখ
- স্বতঃমূল্য সম্পর্কে G.E MOORE-এর তত্ত্ব
- পরিবেশ নীতিবিদ্যা | স্বতঃমূল্য ও পরতমূল্যে
- অধিবিদ্যা কী | অধিবিদ্যার প্রকৃতি আলোচনা করো