আমরা আজকে এই অংশে দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন উত্তর এর আলোচনা করব। সেটি হল কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ কি । বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের পার্থক্য।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ কি । বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের পার্থক্য
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ কাকে বলেঃ-
ইংরেজি ‘ইউটোপিয়া’ শব্দটির অর্থ হল কাল্পনিক আদর্শ সুখ রাজ্য বা রামরাজ্য। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ এক পূর্ন নির্দোষ ও ত্রুটিবিহীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা। থমাস মূর ‘ইউটোপিয়া’ নামক গ্রন্থে পরিষ্কার ভাবে দেখিয়েছেন যে, যাবতীয় সামাজিক অসাম্য এমনকি দারিদ্রতা ইত্যাদির প্রধান কারন হলো সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা ।
তিনি বলেন রাষ্ট্র হল এমন একটি আর্দশ যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু থাকতে পারে না। পরবর্তি কালে (Saint Simon 1760-1825), চার্লস ফুরিয়ে (1772-1837) এবং ইংল্যান্ডের রর্বাট ওয়েন প্রমুখ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী চিন্তার পথিকৃত বলে গণ্য হয়।
চার্লস ফুরিয়ে তৎকালীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দুর্নীতি ও শোষণের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, শিল্পের প্রগতি তথা যন্ত্র সভ্যতা স্বয়ং সমাজের প্রগতির পরিপন্থী ও অভিসার। এই প্রসঙ্গে তিনি সমাজের সাম্য প্রতিষ্ঠা কল্পে সমবায়ের নীতির ওপর গুরুত্ব দেন।
তাঁর মতে, এই সমবায় প্রথায় শ্রমিক ও পুঁজিপতির মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবে। এবং তাদের উভয়ের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেদের স্বার্থের এক আর্দশ সমন্বয় সৃষ্টি করে।
সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি যে , অর্থনৈতিক বৈষম্য জনিত শ্রেণী দ্বন্দ্ব ‘ইউটোপিয়ান’ সমাজতন্ত্রবাদীরা তা উপলব্ধি করতে না পেরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল মানুষের শুভ বুদ্ধির কাছেই আবেদন জানিয়েছেন। এদের প্রত্যকেই তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত মূলক বিপ্লবের পথকে পরিহার করে শান্তির পথ ধরে লক্ষে উপনীত হতে চেয়েছেন।
নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের দ্বারা তাদের ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রের সারসত্তা প্রমান করতে প্রয়াসী হয়েছে। সমাজের গতি প্রকৃতি নির্ধারনের উপর, ঐতিহাসিক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল না হওয়ায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এদের মতবাদ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ নামে পরিচিত।
পরিশেষে বলা যায়, কল্পনাধর্মী সমাজতন্ত্র বাস্তবে রূপায়িত না হতে পারলেও পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে এই চিন্তাবিদদের কঠোর সমালোচনা পরবর্তিকালের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের মূল উৎস রূপে গণ্য করা হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যঃ-
টমাস মুরের একটি লেখনির উপর ভিত্তি করেই কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের ধারনাটির উদ্ভব হয়েছে। কাল্পনিক সমাজতন্ত্র হল এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে কোন শোষণ, দুনীতি, বঞ্চনা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি থাকবেনা। অর্থাৎ সর্বোদোষ মুক্ত সমাজব্যবস্থা সমাজের গতিপ্রকৃতি নির্ধারনের উপর, ঐতিহাসিক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল নয়।
অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ হল সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কিত মতবাদ, যা বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হল ইতিহাস ভিত্তিক তত্ত্বনিষ্ঠ।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের উদ্ভাবক ও প্রচারক রূপে সাঁ সিমোঁ, চার্লস ফুরিয়ে এবং রর্বাট ওয়েনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সের অরাজক সমাজব্যবস্থা লক্ষ্য করেই সাঁ সিমোঁ, চার্লস ফুরিয়ে এক আর্দশ সমাজব্যবস্থার কল্পনা করেন ফরাসী বিপ্লবের ব্যর্থতায় এবং শিল্পবিপ্লবের জন্য ইংল্যান্ডের সমাজ জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে।
অর্থাৎ ধনবৈষম্য, দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের অবসান নানাবিধ অর্থনৈতিক, অসামাজিক ও অমানবিক কাজের পরিচয় পাওয়া যায়।সমাজের এই অবক্ষয় ও অধপতন প্রত্যক্ষ করেই সাঁ সিমোঁ, চার্লস ফুরিয়ে এবং রর্বাট ওয়েন এক পরিবর্তিত নিঃকলুশ সমাজের কল্পনা করেন ।
এই কল্পিত আর্দশ সমাজে আর্থসামাজিক বৈষম্য জনিত শ্রেণী সংঘাত থাকবেনা শোষণ, অত্যাচার, অপরাধ, নারী নির্যাতন থাকবেনা। এখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার শ্রমের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী লাভ করে সুখে ও শান্তিতে জীবন নির্বাহ করবে।অন্যদিকে কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্রবাদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত ।
সমাজ চিন্তাকে কল্পনার প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্ত করে ইতিহাসের বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার জন্যই মার্কসের সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলা হয়। মার্কসের মতে মানুষ যে পরিবেশে বাস করে সেটাই তার বস্তুময় সত্তা।
আর ঐ সত্তাই মানুষের সামগ্রিক জীবনকে তার অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এসবের মধ্যে তার অর্থনৈতিক অবস্থানই প্রধান, কেননা তা ব্যক্তি জীবনের অন্যান্য দিকগুলিকে প্রভাবিত করে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যবস্থার জন্যই শ্রেণীদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে মানব সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে ।
কিন্তু এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব চিরন্তন হতে পারেনা। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন পুঁজিপতি শ্রেণীকে পরাজিত করে সর্বহারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে।
পরিশেষে বলা যায়, আপাত দৃষ্টিতে কাল্পনিক সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে বলে মনে হলেও মূল্যগত ভাবে উভয়ের মধ্যেই তেমন কোন ভেদ নেই।
Thanks For Reading: কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ কি । বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের পার্থক্য
প্রশ্ন উত্তর:-
১.ইংরেজি ‘ইউটোপিয়া’ শব্দটির অর্থ কি?
উত্তর-ইংরেজি ‘ইউটোপিয়া’ শব্দটির অর্থ হল কাল্পনিক আদর্শ সুখ রাজ্য বা রামরাজ্য।
২.ইউটোপিয়া’ নামক গ্রন্থটি কার লেখা?
উত্তর-থমাস মূর ইউটোপিয়া’ নামক গ্রন্থটির লেখক।
3.কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের চিন্তার পথিকৃত কারা?
উত্তর-Saint Simon (1760-1825), চার্লস ফুরিয়ে (1772-1837) এবং ইংল্যান্ডের রর্বাট ওয়েন প্রমুখ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী চিন্তার পথিকৃত বলে গণ্য হয়।
আরো পড়ুনঃ
1. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে আলোচনা করো।
২. চার্বাক দর্শন বড় প্রশ্ন উত্তর
৩. আইনের সংজ্ঞা দাও | এর বৈশিষ্ট্য গুলি কী কী
4. রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করো