সত্য দ্রষ্টা সাধক গৌতম বুদ্ধ দার্শনিক বা তত্ত্বজ্ঞ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি ধর্মের প্রবর্তক এবং নীতিবিদ। তাই তিনি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চেতনায় মানুষকে করে ছিলেন উদ্বোধিত। বুদ্ধদেবের দার্শনিক তত্ত্বগুলির মধ্যে অন্যতম হল নৈরাত্মবাদ। এই পর্বে আমরা যে প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করব তা হল –বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ বা অনাত্মাবাদ ব্যাখ্যা করো।
বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ ব্যাখ্যা কর ? এই মতবাদ কতটা গ্রহণযোগ্য ?
ভুমিকা-
লৌকিক মতে আত্ম হল জড় পদার্থ । কিন্তু ভারতীয় আধ্যত্মবাদী দর্শনে আত্মাকে নিত্য, শাশ্বত, সনাতন এক অপরিবর্তনীয় সত্তা বলে গণ্য করা হয়েছে। উপনিষদে আত্মা সম্পর্কে বলা হয়েছে –
“নজায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বান ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঃ অয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।”
অর্থাৎ আত্মা জন্ম-মৃত্যু রহিত, ইনি সৎরূপে সদাবিদ্যমান। শরীরের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু হয় না। উপনিষদে আরো বলা হয়েছে যে – আত্মা চৈতন্যস্বরূপ এবং দেহ থেকে পৃথক এর অস্তিত্ব। কিন্তু নৈয়ায়িক ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ প্রমুখ দার্শনিক সম্প্রদায় উপনিষদীয় আত্মতত্ত্ব স্বীকার করলেও , তাঁরা বলেন আত্মা চৈতন্যস্বরূপ নয়, চৈতন্যগুণবিশিষ্ট । জড়বাদী চার্বাকগণ উক্ত মতগুলির বিরোধিতা করে বলেন, চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা। আত্মা সম্পর্কে উপনিষদীয় তত্ত্ব শাশ্বতবাদ নামে পরিচিত এবং জড়বাদী চার্বাকগণের তত্ত্ব নাস্তিত্ববাদ নামে পরিচিত।
বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ
বৌদ্ধগণ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা যেমন উপনিষদীয় শাশ্বতবাদ খণ্ডন করেছেন, তেমনই চার্বাকগণের নাস্তিত্ববাদও খণ্ডন করেছেন। বৌদ্ধ দর্শন প্রত্যক্ষ অনুমান প্রমাণবাদী। বৌদ্ধ মতে, উপনিষদীয় আত্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ ও অনুমানের দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই তাদের মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। আবার একই ভাবে তার চার্বাক নাস্তিত্ববাদকেও খণ্ডন করেছেন। কারন , চার্বাক দেহাত্মবাদ মানলে জ্ঞান, প্রত্যভিজ্ঞা, স্মৃতি ও কর্মবাদের কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। তাছাড়া দেহ যদি আত্মা হয় তাহলে মানুষের দুঃখের পরিসমাপ্তি হবে কি ভাবে ।বৌদ্ধগণ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। এখন প্রশ্ন হল বৌদ্ধ দর্শনে তাহলে আত্মার স্বরূপ কি?
বুদ্ধদেবের দৃষ্টিতে অ- পরিবর্তনীয় সদ্ বলে কিছু নেই, সবই অনিত্য। এই অনিত্যবাদের ফলশ্রুতি হল নৈরাত্মবাদ বা অনাত্মাবাদ। নৈরাত্মবাদ অনুসারে আত্মার কোন চিরন্তন নিত্য ও শাশ্বত সত্ত্বা নেই। বুদ্ধদেবের চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা, দ্বেষ ইত্যাদি মানসিক অবস্থানগুলি স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাদের আধার কর্তা ও ভোক্তা রূপে তাদের অপরিবর্তনীয় আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। তাঁর মতে, আত্মা আছে, তবে তা বিভিন্ন মানসিক অবস্থার অবিরাম ধারা বা প্রবাহ।
বুদ্ধদেব যখন বলেন জীবন হল সদা পরিবর্তনশীল, তখন আপত্তি হয় যে জীবন সদা পরিবর্তনশীল হলে শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য প্রভৃতি জীবনের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে কোন যোগসূত্র স্থাপন করা যাবে না। এই আপত্তির উত্তরে তিনি বলেন মানুষের মধ্যে আত্মা বলে স্থায়ী সত্তা না থাকলেও তার জীবনে বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে ধারাবাহিকতা আছে। জীবনের এই ধারা প্রবাহের মধ্যে যে কোন একটি অবস্থা যেমন তার পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে উদ্ভূত তেমনি তা আবার তার পরবর্তী অবস্থাকে সৃষ্টি করে। জীবনের এই ধারাবাহিকতা তা মূলে আছে কার্যকারন সম্বন্ধ বা বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করে চলেছে।
তাই কোন ব্যক্তি সারাজীবন নিজেকে এবং ও অভিন্ন ব্যক্তি বলে উপলদ্ধি করে। গৌতম বুদ্ধ একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। সারারাত্রি ব্যাপি জলন্ত একটি প্রদীপ শিখা প্রতি মূহুর্তে তার নিজস্ব অবস্থার উপর নির্ভরশীল এবং অপর মূহুর্তের শিখা থেকে ভিন্ন। প্রথম মূহুর্তের শিখা যে সলতে বা তেলের অংশের উপর নির্ভর করে জ্বলছে, দ্বিতীয় মূহুর্তের শিখা সেই সলতে বা তেলের অংশের উপর নির্ভর করেনা, কেননা ইতিপূর্বে সেই সলতে বা তেলের অংশ পুড়ে নিয়েছে। আবার বিভিন্ন মূহুর্তের শিখা গুলি পরস্পর ভিন্ন হলেও প্রদীপের একটা ধারাবাহিকতা বর্তমান। অনুরূপেভাবে মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভিন্ন হলেও সমস্ত জীবনের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে।
কেউ কেউ বলেন নৈরাত্মবাদ, জন্মান্তরবাদ বিরোধী। জন্মান্তর না মানলে কার্য-কারণ ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না। অথচ গৌতমবুদ্ধ কার্য-কারনে বিশ্বাসী। উত্তরে বৌদ্ধগন বলেন যে, জন্মান্তরের অর্থ কোন একই চিরন্তন আত্মার নতুন দেহে পরিগ্রহ নয়। জন্মান্তের অর্থ হল পূর্বজীবন থেকে পরজীবনের উদ্ভব। দুটি প্রদীপ সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও যেমন একটি প্রদীপ থেকে অপর একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা যায় , তেমনি একটি জীবন থেকে আর একটি জীবন উদ্ভূত হয়। এভাবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে একটা ধারাবাহিকতা স্রোত বয়ে চলছে। যার জন্য কোন আত্মার সনাতন অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজন হয় না।
পঞ্চস্কন্ধঃ
গৌতমবুদ্ধের মতে, মানুষ পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি। এই পঞ্চস্কন্ধ হল – রূপ স্কন্ধ, বেদনা স্কন্ধ, সংজ্ঞা স্কন্ধ,সংস্কার স্কন্ধ এবং বিজ্ঞান স্কন্ধ। ক্ষিতি, অপ, তেজঃ ও মরুৎ এই চারটি ভূতে গঠিত জড়দেহ হল রূপ স্কন্ধ।
১. রূপ স্কন্ধ- এই রূপ স্কন্ধ হল দৈহিক উপাদান।
২. বেদনা স্কন্ধ- সুখ -দুঃখ , উদাসিন্য প্রভৃতি হল বেদনা স্কন্ধ।
৩. সংজ্ঞাস্কন্ধ- বিষয়ের প্রত্যক্ষন হল সংজ্ঞাস্কন্ধ।
৪. সংস্কার স্কন্ধ- মানসিক প্রবণতা, সংশ্লেষক ক্রিয়া, ঐচ্ছিক ক্রিয়া প্রভৃতি হল সংস্কার স্কন্ধ এবং
৫. বিজ্ঞানস্কন্ধ– বিচার বুদ্ধি হল বিজ্ঞানস্কন্ধ।
এই পঞ্চস্কন্ধের সমাহার হল আত্মা।
বৌদ্ধ মতে উক্ত পঞ্চস্কন্ধ নিয়েই জীব দেহ গঠিত, তা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নাগসেন ও গ্রিক রাজা মিলিন্দার আত্মা সংক্রান্ত কথোপকথন থেকে জানতে পারি। আত্মা সংক্রান্ত আলোচনায় নাগসেন মিলিন্দাকে বলেন রূপ, চক্র, দন্ড, চূড়া, সারথী ও রথী ইত্যাদির সমাহার যেমন রথ, তেমনি জীবের আত্মা পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি ভিন্ন আর কিছুনয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বৌদ্ধদের আত্মা সমর্কিত মতবাদ আধুনিক কালের পাশ্চাত্য দার্শনিক এবং আমেরিকান দার্শনিক মোনোবিদ উইলিয়াম জেমস এর মতবাদের সঙ্গে তুলনীয়। তাঁরা চৈতন্যের নিরবিচ্ছিন্ন ধরাকে চেতনা প্রবাহকেই আত্মা বলেছে।
সমালোচনা-
অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিকের মতে বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ স্বীকার করলে নানা অসুবিধার উদ্ভব হয়। তাই জৈন, ন্যায় প্রভৃতি দর্শনে নৈরাত্মবাদ নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে –
(i) নৈরাত্মবাদ স্বীকার করলে বৌদ্ধ দর্শনে স্বীকৃত কার্যবাদ ও জন্মান্তরবাদ ব্যাখ্যা করা যায়না। যদি সবকিছুই পরিবর্তনশীল হয় এবং আত্মা বলে অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা না থাকে তাহলে যে কার্য সম্প্রদান করে সে কর্ম ফল ভোগ করবে না । এর ফলে কৃত প্রমাণ দোষ হয়। আবার যে কার্য করেনি সে ফল ভোগ করবে ফলে অকৃত প্রমাণ দোষ হয়। নিত্য আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে কে কার্য করবে এর কে কর্ম করবে এর কে কর্মফল ভোগ করবে ?
(ii) অদ্বৈত বেদান্তবাদী শঙ্করাচার্য আত্মা সম্বন্ধে বৌদ্ধ মতের সমালোচনা করে বলেন আত্মা তথা জ্ঞাতার অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা না মানলে জ্ঞান সম্ভব হবে না।
Thanks For Reading : বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ বা অনাত্মাবাদ ব্যাখ্যা করো।
প্রশ্ন-উত্তর
১. বৌদ্ধ ধর্মে আত্মা কি?
উত্তর- বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ অনুসারে আত্মার কোন চিরন্তন নিত্য ও শাশ্বত সত্ত্বা নেই। আত্মা আছে, তবে তা বিভিন্ন মানসিক অবস্থার অবিরাম ধারা বা প্রবাহ।
২. অনাত্ম শব্দের অর্থ কি?
উত্তর- অনাত্ম শব্দের অর্থ হল আধার কর্তা ও ভোক্তা রূপে অপরিবর্তনীয় আত্মার অস্তিত্ব না থাকলেও ,আত্মা বিভিন্ন মানসিক অবস্থার অবিরাম ধারা বা প্রবাহ।
আরো পড়ুন –
বৌদ্ধ দর্শনের অষ্টাঙ্গিক মার্গ বর্ণনা
জৈনদের অনেকান্তবাদ সমালোচনা সহ ব্যাখ্যা করো
চার্বাক নীতি তত্ত্ব -সুখবাদ কী?
ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ