Satyagraha | গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দলন

ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দলন এক অভাবনীয় প্রতিরোধের হাতিয়ার। এই আন্দলনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো যে গান্ধীজী ভারতের স্বাধীনতা আন্দলনে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের অধীকার প্রতিষ্ঠায় কী ভাবে সত্যাগ্রহকে আদর্শ রূপে প্রয়োগ করে ছিলেন।

satyagraha gandhiji
satyagraha gandhiji

Satyagraha | গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দলন

ভূমিকাঃ

গান্ধীজীর রাজনৈতিক চিন্তা  দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ন  আবিষ্কার হল সত্যাগ্রহ। এটি সশস্ত্র প্রতিরোধের বিপরীত। গান্ধীজী শান্তিবাদী ছিলেন , এবং অস্ত্র হাতে যুদ্ধের পক্ষ পাতীত্বও করতেন না। তাই তিনি প্রতিবাদের বা যুদ্ধের বিকল্প হিসাবে এমন একটি পথ আবিষ্কার করলেন, সেই পথই হল সত্যাগ্রহ।

সত্যাগ্রহের উৎস –

গান্ধীজীর জীবনে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে ছিল বেশ কয়েকটি গ্রন্থ যথা- শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার কর্মযোগ, বাইবেল, রাসকিন বন্ডের লেখা “unto the Last” এবং লিত্ত টলস্টয় রচিত  “The Kingdom Of God is within you” প্রভৃতি গ্রন্থ।

এই সব গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে গান্ধীজী উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রেমের দ্বারাই একমাত্র অন্যায়কে প্রতিরোধ করা যায়। তাই গান্ধীজী বলেছেন সত্যাগ্রহ হল এমন একটি প্রতিরোধ শক্তি বা আত্মিক শক্তি যা অহিংসার পথ ধরে অন্যায়কে প্রতিহত করে।

সত্যাগ্রহের অর্থ – 

গান্ধীজীর কাছে ‘সত্য হল ঈশ্বর’ এবং সত্য সম্পর্কে আগ্রহ হল সত্যাগ্রহ। অর্থাৎ সত্যাগ্রহ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘Passion for the truth’ বা সত্যের প্রতি আগ্রহ এবং সত্যকে উপলব্ধি করার যে কামনা তাই হল সত্যাগ্রহ।

হিন্দ স্বরাজ গ্রন্থে তিনি বলেছেন – “সত্যাগ্রহ হল ব্যক্তিগতভাবে কষ্ট স্বীকার করে অধিকার অর্জন। ” বস্তুত, সত্যাগ্রহ হল বলপ্রয়োগ না করে অর্থাৎ ঘৃনা ক্রোধ ও হিংসার আশ্রয় না নিয়ে যুদ্ধ করার এক অভিনব কৌশল।

সত্যাগ্রহ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল – ‘Passion for the truth’ অর্থাৎ সত্যের প্রতি আগ্রহ এবং সত্যকে উপলব্ধি করার যে বাসনা তাই হল সত্যাগ্রহ। এই সত্যের আর এক নাম হল Justice বা ন্যায়। গান্ধীজীর মতে সত্যাগ্রহ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে আমরা তিনটি অর্থ পেতে পারি –

১. সত্যের সাথে সংযুক্ত থাকা।

২. সত্যকে অবলম্বন করা। ও

৩. সত্যকে নিজের জীবনের একমাত্র অবলম্বন রূপে স্বীকার করা।

এই তিনটি অর্থের লক্ষ্য একটি তা হল সত্য। এই সত্যের প্রতি আগ্রহই হল সত্যাগ্রহ। এই সত্যের উদ্দেশ্য হল আমাদের Good Life। অর্থাৎ সত্যের পথ অবলম্বন করে মানুষ যেন সুখে-শান্তিতে তার জীবন-যাপন করতে পারে। যে সত্যকে অবলম্বন করে মানুষ বেঁচে থাকে তাকে আমরা Seeker of truth বলি। আর যে সত্যকে খুঁজছে তিনি হলেন সত্যাগ্রহী

গান্ধীজীর সত্যাগ্রহের প্রকৃতি | What is satyagraha

১. সত্য ও অহিংসা

গান্ধীজী বলেন যে সত্যাগ্রহ তিনটি নীতির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে তা হল love equality, self scarifies (ভালোবাসা, একতা, ও আত্মত্যাগ )। গান্ধীজী বলেন এই তিনটি নীতি যখন আমরা সত্যাগ্রহ চর্চায় অবলম্বন করি তখন আমরা সত্য ও অহিংসাকে বাদ দিতে পারি না কারণ সত্য ও অহিংসার সাথে love ও equality ঘনিষ্ট ভাবে জরিত থাকে।

সুতরাং, সত্যাগ্রহের মধ্যে থাকে কেবল প্রেম, প্রীতি এবং ভালোবাসা, এবং মানুষকে আপন করে নেওয়ার প্রবণতা। আর এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধীজী সর্বোদয়ের ধারণা গড়ে তুলেছিলেন। সর্বশেষে সত্যাগ্রহ সম্পর্কে আমারা দুটি ধারণা পেয়ে থাকি –

১. সত্যের সাথে ভালোবাসা বা অভিন্ন ভাবে যুক্ত এবং

২.  সত্য আসে মন থেকে।

২.আত্মত্যাগ

গান্ধীজীর মতে সত্যাগ্রহ কেবলমাত্র নৈতিকতার উপর প্রতিষ্টিত নয়। এর সাথে ধর্ম, ধর্মের সাথে মানবতা মানবতার সাথে শিল্প রাজনীতি যুক্ত থাকে। অতএব আমরা কখনই বলবো না নৈতিকতা মানে কেবল নৈতিকতা, ধর্ম মানে কেবল ধর্ম। গান্ধীজী বলেন এই সত্য আমাদের আত্মত্যাগ করতে শেখায়।

৩.নিস্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়

গান্ধীজীর মতে  সত্যাগ্রহ ও Passive resistance ( নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ ) এক ধারণা নয়। সত্যাগ্রহে থাকে কেবল ভালোবাসা, কিন্তু Possible resistance এ ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃনা বা হিংসা থাকতে পারে। সত্যাগ্রহ কখনও মানুষকে হাতিয়ার তুলে নিতে বলে না। কিন্তু Passive resistance হাতিয়ার তুলে নিতে বলে।

4.সত্যাগ্রহ আত্মিক বল, দৈহিক বল নয়

যে কাউকে আমি ভুল বা অন্যায় বলে মনে করি, যেখানে আমার বিবেকের সায় থাকে না, সেই কাজ অবশ্যই অন্যায়। এই অন্যায়কে যতক্ষন আমি মেনে নিই ততক্ষণ আমি পরাধীন বা সত্য থেকে আমি সরে রয়েছি। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা যুদ্ধ আবশ্যক।

প্রতিবাদ বা যুদ্ধের জন্য শক্তির প্রয়োগ করতে হয়। শক্তি প্রয়োগ আমরা দুভাবে করতে পারি এক, আমি অস্ত্র ধারন করে দৈহিক বল বা শক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করতে পারি এবং আত্মি শক্তি প্রয়োগ করেও যুদ্ধ করতে পারি। আত্মিক বল প্রয়োগ হল এমন এক শক্তি যার দ্বারা আমি অন্যায়কে স্বীকার না করে, সত্যের পথে থেকে স্বেচ্ছায় নিদিষ্ট সাজা বরণ করি।

সুতরাং  গান্ধীজী দেখালেন দৈহিক শক্তি বা অস্ত্রশক্তি ছাড়াও এমন শক্তি আছে যেখানে কোন অস্ত্রের প্রয়োজন হয় না, সেই শক্তি হল ভালোবাসার শক্তি, আত্মত্যাগের শক্তি, অহিংসার .শক্তি- এই শক্তিই সত্যাগ্রহীর আত্মিক শক্তি।

৫.সত্যাগ্রহ সবলের অস্ত্র

সত্যাগ্রহী নিজেই নিজের অস্ত্র। আত্মিক বলই তার অস্ত্র। এই অস্ত্র দুর্বলের নয়, সবলের অস্ত্র। কারণ সত্যাগ্রহের জন্য যে সাহসের প্রয়োজন হয় দৈহিক বল প্রয়োগকারীর তা নেই। তোপের মুখে পরে শয়ে শয়ে লোককে হত্যা করতে সহজ না, বরং তোপের মুখে পরে হাসতে হাসতে মৃত্যুবরন করতে অধিক সাহসের প্রয়োজন হয়।

যে নিজের মৃত্যুকে মাথায় করে বেড়ায় সেই প্রকৃত বীর, অন্যের মৃত্যুকে নিজের হাতে রাখে তিনি বীর নন। সুতরাং সত্যাগ্রহী আত্মিক বলে বলীয়ান হয়ে হিংস্রের মতো সাহস নিয়ে চলাফেলা করবে।

৬. সত্যাগ্রহ বীরত্বপূর্ন ও মহত্ব পূর্ন   যুদ্ধ

যুদ্ধকে এড়াতে চাইলে যুদ্ধের বদলে এমন কোন সক্রিয় ও কার্যকরী উপায় বের করতে হবে, যাতে যুদ্ধের মতোই কাজ হয় অথচ যুদ্ধের হিংসা ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতা থাকবে না সেই যুদ্ধের নাম Satyagraha Movement। সত্যাগ্রহের যুদ্ধে ধ্বংশের কোন সম্পর্ক নেই। সত্যাগ্রহ একপ্রকার অত্যন্ত বীরত্বপূর্ন ও মহত্ত্বপূর্ন যুদ্ধ।

এক ফোঁটা রক্তপাত না করেও সুদূর প্রসারী ফল পাওয়া যায়। এই অস্ত্রে মরচে পরে না, কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনা। সত্যাগ্রহ এমন একটি তলোয়ার যার কোন খাপের প্রয়োজন হয় না, যার সব দিকেই ধার।

৭. সত্যাগ্রহীর আবশ্যিক গুণাবলী

সত্যাগ্রহীর এই সব কিছু পালনের মধ্য দিয়ে চেতনার কতকগুলি গুণের বিকাশ ঘটবে। যেই গুণ গুলি হল। –

১. ভাতৃত্ব বোধ।

২. পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে স্বসম্মানে বেঁচে থাকার তাগিদ ও

৩. যুদ্ধ বিরোধিতা। গান্ধীজীর মতে সত্যাগ্রহ অবলম্বন যুদ্ধ এরোনো সম্ভব নয়, আমাদের পৃথিবীতে শান্তি বজায় থাকে।

গান্ধীজী বলেছিলেন যে সত্যকে অনুসন্ধান করে যে হল সত্যাগ্রহী। এই সত্যাগ্রহী জীবনে কিছু উদ্দেশ্য আছে অর্থাৎ একজন সত্যাগ্রহীকে জীবনে কিছু বিষয় পালন করতে হয় যেগুলি হল –

১. ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে।

২. নিরামিশাষী হতে হবে।

৩. হিংসার পথ পরিত্যাগ করতে হবে।

৪. অপরের জিনিসে লোভ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।

সত্যাগ্রহ ও নিষ্ক্রিয় বা প্যাসিভ প্রতিরোধ এর মধ্যে পার্থক্য 

গান্ধীজী সত্যাগ্রহের স্বরূপ আলোচনার প্রসঙ্গে সত্যাগ্রহ ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। পার্থক্য গুলি হল –

প্রথমত, সত্যাগ্রহ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ বা ভালোবাসা। অর্থাৎ সত্যাগ্রহের মধ্যে ভালোবাসা ছাড়া ঘৃনা বলে কিছু থাকে না। কিন্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ এমন এক ধরণের প্রতিরোধ যেখানে ভালোবাসা ছাড়া ঘৃনা বোধ থাকতে পারে।

দ্বিতীয়ত, সত্যাগ্রহ হল একটি সদর্থক ধারণা কারণ এই আদর্শে বলা হয় সত্যাগ্রহীকে অসত্য থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ একটি নঞর্থক ধারণা।

তৃতীয়ত, সত্যাগ্রহে প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে কখনই হাতিয়ার তুলে নেওয়ার কথা বলা হয় না। অপরদিকে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ ঘৃনা হিংসা , ক্রোধ, লোভ প্রভৃতির স্থান রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে ক্ষেত্র বিশেষে হাতিয়ার তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়।

চতুর্থত, সত্যাগ্রহে মানুষ মানুষকে আপন করে নেয়, প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসার মাধ্যেমে। কখনই সত্যাগ্রহী তার শত্রুকে আঘাত করে না। অপরদিকে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধে মানুষ মানুষকে আঘাত করে, মানুষ মানুষের সাথে মানুষত্ব – হীন আচরণ করে।

পঞ্চমত, সত্যাগ্রহী হয় কর্মযোগী, কেবল সত্যনিষ্ঠ ভাবে কর্ম করাই তার কর্তব্য। কিন্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে লোভ লালসার প্রাধান্য থাকায় কর্মের সাথে সত্য নিষ্ঠার সম্পর্ক খুব কম।

সমালোচনাঃ

গান্ধীজী আদর্শিত সত্যাগ্রহে কিছু সমালোচনার দিক রয়েছে-

প্রথমত, গান্ধীজী সম্মত সত্যাগ্রহের পথ অতি দূর্গম, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, কর্ম ফলে আকাক্ষা পরিত্যাগ করে সমাজ সেবাকে একমাত্র লক্ষ করলেন। সেই লক্ষে পৌঁছানো একমাত্র নিষ্কাম কর্মযোগের পক্ষেই সম্ভব। সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষ বিষয় চিন্তা , স্বার্থবুদ্ধি এই সব কিছুকে পরিত্যাগ করতে পারে না। তাই তাদের কাছে সত্যাগ্রহের আদর্শ মেনে চলাটা দুষ্কর হয়ে পরে।

Conclusion: সুতরাং গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ  মানুষকে সত্যের পথ দেখায়, চলার পথকে সুন্দর করে তোলে। একজন সত্যাগ্রহী সত্যের পথে চলে সমাজকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে পারে। একজন সত্যাগ্রহী  প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা মাধ্যমে এক  আদর্শ  মানব সত্ত্বায় উন্নীত হন।

প্রশ্ন- উত্তর

১.মহাত্মা গান্ধী ডাক নাম কি?

উত্তর-  মহাত্মা গান্ধী ডাক নাম হল বাপু।

২. সত্যাগ্রহ কি সংক্ষিপ্ত উত্তর?

উত্তর-  সত্যাগ্রহ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘Passion for the truth’ বা সত্যের প্রতি আগ্রহ এবং সত্যকে উপলব্ধি করার যে কামনা তাই হল সত্যাগ্রহ।

৩. গান্ধীজী সত্যাগ্রহ কেন করেছিলেন?

উত্তর- রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে 1919 খ্রিস্টাব্দে সত্যাগ্রহের ডাক দিয়েছিলেন।

৪. গান্ধী কতগুলি সত্যাগ্রহ করেছিলেন?

উত্তর- গান্ধীজী চারটি সত্যাগ্রহ করেছিলেন যথা- চম্পারণ সত্যাগ্রহ (১৯১৭), আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহ(১৯১৮) , খেদা সত্যাগ্রহ(১৯১৮) ,  রাওলাট সত্যাগ্রহ(১৯১৯)

৫.গান্ধীজি কে বাপু কে ডেকেছিলেন?

উত্তর- গান্ধীজি কে বাপু বলে ডাকতেন  সুভাষ চন্দ্র বসু ।

6. সত্যাগ্রহ প্রথম কে করেন?
উত্তর-  বিনোবা ভাবে প্রথম সত্যাগ্রহ করেন.
Read More:
  1. ভারতীয় দর্শন | Indian Philosophy |দর্শন শব্দের অর্থ 

Leave a comment